মানসিক চাপে ভুগছে ৬০ শতাংশের বেশি শহুরে কিশোর-কিশোরী : গবেষণা
বাংলাদেশের ১৩-১৯ বছর বয়সি শহুরে ছেলেমেয়েদের ৬০ শতাংশের বেশি মাঝারি থেকে তীব্র মানসিক চাপে ভুগছে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে।
বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন, পাবলিক হেলথ ইন্সটিটিউট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি সংস্থার করা যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে—সন্তানদের এ ধরনের মানসিক চাপের ব্যাপারে পরিবার বা অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা খুবই কম। সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, স্ট্রেস বা মানসিক চাপের ফলে কিশোর-কিশোরীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। যেমন, নাগরিক এ কিশোর-কিশোরীদের একটি বড় অংশ স্থূলতা ও বিষণ্ণতা বা অবসাদে ভোগে।
এ ছাড়া শহুরে ছেলেমেয়েদের মধ্যে শারীরিকভাবে সক্রিয় অর্থাৎ নিয়মিত খেলাধুলা এবং কায়িক পরিশ্রমের কাজ করে মাত্র আড়াই শতাংশের কিছু বেশি কিশোর-কিশোরী। ফলে মানসিক চাপ সামলাতে পরিবার এবং স্কুলের সহায়তাও খুবই কম পায় তারা।
কী নিয়ে মানসিক চাপে থাকে কিশোর-কিশোরীরা?
গবেষণার একজন সহ-গবেষক আমব্রিনা ফেরদৌস বলেছেন, জরিপটি মহামারি শুরুর আগে ২০১৯ সালে ঢাকাসহ দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে পরিচালনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বিএমআরসি গবেষণা নিবন্ধটি অনুমোদন দিয়েছে।
গবেষণাটি ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সি সাড়ে চার হাজারের বেশি কিশোর-কিশোরীর সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে পরিচালনা করা হয়েছে।
বয়ঃসন্ধিকালে সারা পৃথিবীতেই ছেলেমেয়েরা নানা রকম মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। আর, হরমোনের নানা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশার চাপ।
ভালো স্কুলে শিক্ষার সুযোগ পাওয়া, ভালো ফলসহ শিক্ষা কার্যক্রমে সাফল্য—এমন নানাবিধ চাপ তৈরি হয় ছেলেমেয়েদের ওপর।
আমব্রিনা ফেরদৌস বলছেন, গবেষণায় দেখা গেছে—ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপ বোধ করে পড়াশোনা নিয়ে।
এ ছাড়া ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, স্কুলের পারফরম্যান্স এবং রোমান্টিক সম্পর্কের কারণেও মানসিক চাপে পড়ে তারা।
আমব্রিনা ফেরদৌস বলেন, ‘পরীক্ষার রেজাল্ট, মা-বাবার প্রত্যাশা এবং স্কুলে পড়াশোনার চাপ থেকে তারা সবচেয়ে বেশি স্ট্রেস ফিল করে। সেইসঙ্গে ভবিষ্যতে কোথায় পড়তে যাবে, কী করবে—এ সব নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে এ বয়সি ছেলেমেয়েরা।’
আবার নিজেদের শারীরিক অবয়ব, মানে তাদের কেমন দেখাচ্ছে, তা নিয়েও এ বয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা বিরাট স্ট্রেস তৈরি হয়।
‘এর একটা কারণ হচ্ছে, শহুরে ছেলেমেয়েদের খাদ্যাভ্যাসে জাঙ্কফুড খাওয়ার প্রবণতা বেশি। আর খেলাধুলার সুযোগও কম, ফলে তাদের মধ্যে ওবিসিটির (স্থূলতা) সমস্যা প্রকটভাবে রয়েছে। ফলে এ নিয়েও ছেলেমেয়েরা মানসিক চাপের মধ্যে পড়েৱ, বলছেন আমব্রিনা ফেরদৌস।
এ মানসিক চাপের কারণ কী?
আমব্রিনা ফেরদৌস জানান, তাঁরা দেখছেন—কিশোর বয়সি ছেলেমেয়েদের মঙ্গে মা-বাবার মানসিক দূরত্ব, নাগরিক জীবনে একক পরিবার কাঠামোর কারণে একাকীত্ব, স্কুলে বা অবসর সময়ে সমবয়সিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, বুলিয়িং—এসব কারণে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়।
মানসিক চাপের কারণে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। প্রায়ই তারা নিজেদের সমস্যার কথা তারা পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। সমস্যা কথা শেয়ার করা, কিংবা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধু বা সমবয়সিদের ওপর নির্ভর করে।
এ ছাড়া বাড়তি ওজন কমানোর জন্য শারীরিক পরিশ্রমের কাজ কিংবা বিশেষজ্ঞ পরামর্শের বদলে খাওয়া কমিয়ে দেয়, যা পরে তাদের শরীরে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি করে।
কতটা ব্যাপক এ সমস্যা?
গবেষণায় পাওয়া তথ্য বলছে, ২৬ শতাংশের বেশি শহুরে কিশোর-কিশোরীর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া ৩০ শতাংশের বেশি ছেলেমেয়ে দিনের বড় সময় বাড়ির ভেতরেই থাকে।
এ ছাড়া ঘরের বাইরে খেলাধুলা এবং কায়িক পরিশ্রমের কাজ করে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরী।
শহর এলাকায় খোলা জায়গার অভাব এবং ইনডোর গেমের প্রতি আকর্ষণের কারণে ওবিসিটির সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।
আমব্রিনা ফেরদৌস বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা বাড়ছে, কিন্তু নানা ধরনের বিষণ্ণতা এবং অবসাদ কিংবা আত্মহত্যার মতো ঘটনাও বাড়ছে।
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে এক ধরনের সামাজিক ট্যাবু কাজ করে, বেশির ভাগ মা-বাবা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না।
আর মা-বাবার এ কথা না বলা, বা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কারণে ছেলেমেয়েদের জীবনে ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসতে পারে।
অনেকেই না বুঝে কুসংসর্গে পড়ে বিপথগামী হয়, কেউ মাদকাসক্তিসহ নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়।
আমব্রিনা ফেরদৌস বলছেন, ‘বয়ঃসন্ধিকালে তাদের সাহায্য দরকার। তারা যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, তা নিয়ে সচেতনতার কথা বলা হলেও এ নিয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। পরিবার ও স্কুলের ভূমিকা এখানে আরও অনেক জোরালো হওয়া দরকার।’
সমস্যা চিহ্নিত করে, একে এড়িয়ে না গিয়ে সমাধানের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গবেষণায়।