মাশরুম চাষে সবজি বিক্রেতা স্বাবলম্বী
ইউটিউবে ভিডিও দেখে মাশরুম চাষে আগ্রহী হন নওগাঁর সবজি বিক্রেতা সাগর আলী। প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বল্প পুঁজিতে প্রথমে ছোট পরিসরে শুরু করেন মাশরুম চাষ। মাশরুম চাষ লাভজনক হওয়ায় আস্তে আস্তে তিনি বড় পরিসরে মাশরুমের খামার গড়ে তোলেন। এতে তিনি বেশ সফলও হয়েছেন।
খুব কম সময়ের মধ্যে লাভের মুখ দেখছেন সাগর আলী। মাশরুম বিক্রি করে সংসারেও ফিরিয়েছেন আর্থিক স্বচ্ছলতা। তিনি নওগাঁ সদর উপজেলার কীর্ত্তপুর ইউনিয়নের বেনী-ফতেপুর এলাকার বাসিন্দা।
সাগর আলীর মাশরুম খামারে গিয়ে দেখা যায়, দুই কাঠা জমির উপরে টিন দিয়ে ঘর তৈরি করেছেন। ওই ঘরে সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে পলিথিন দিয়ে মোড়ানো ৩০০টি মাশরুম বীজ প্যাকেট (স্পন প্যাকেট)। সেই পলিথিনের গায়ে সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে সাদা আস্তরনে দেখা যাচ্ছে মাশরুম। সেখান থেকেই কেটে বাজারজাত বা বিক্রি করছেন তিনি। এ ছাড়া প্রতিদিন তার খামারে মাশরুম কিনতে এবং দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ আগ্রহী হয়ে উঠছেন পুষ্টিগুণে ভরপুর এই মাশরুম চাষে।
স্থানীয় সাজ্জাদ আলী বলেন, ‘শুনলাম সাগর ভাই তার বাড়ির পাশে মাশরুম চাষ করেছেন। এই জন্য দেখতে এলাম। মাশরুম চাষ সম্পর্কে আমাদের আগে জানা ছিল না। এমনকি মাশরুমের নামও জানা ছিল না। কম খরচে মাশরুম চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন তিনি। তাই চিন্তা-ভাবনা করছি তার কাছ থেকে মাশরুম চাষ শিখে আমিও বাগান করব।’
হামিদুর রহমান নামে আরেকজন বলেন, মূলত এখানে এসেছি মাশরুমের খামার দেখতে। দেখে খুবই ভালো লাগল। শুনলাম মাশরুম চাষে তেমন কোনো খরচ নেই। আমিও মাশরুম চাষ করার উদ্যোগ নেব। যাতে অল্প খরচে লাভবান হওয়া যায়। তার কাছ থেকে পরামর্শ নেব কীভাবে মাশরুম চাষ করা যায়।
নওগাঁ শহর থেকে মাশরুম কিনতে এসেছেন আব্দুল্লাহ আল মুসাব্বের। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যের জন্য ভালো যে খাবারটা; মাশরুম তার মধ্যে অন্যতম। চোখের জন্য, ডায়াবেটিসের জন্য, ব্লাড প্রেসার কন্ট্রোলের জন্য বলেন সব দিক থেকে এই খাবারটা আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী। কিন্তু আমাদের এলাকায় সেভাবে মাশরুম পাওয়া যায় না। আমার এক ছোট ভাই এখান থেকে মাশরুম কিনে নিয়ে খেয়ে ভালো বলেছে। এই জন্য তার কথা শুনে আমিও মাশরুম কিনতে এখানে এসেছি। এখানে এসে একদম টাটকা এক কেজি মাশরুম কিনলাম। দামও কম আছে।’
আব্দুল্লাহ আল মুসাব্বেরের সঙ্গে এসেছেন মাহবুব আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা মাশরুম সুপার শপ থেকে কিনে খেয়েছি। এখন বাড়ির কাছে সাগর ভাই মাশরুম চাষ করছেন। অবশ্যই এটি ভালো উদ্যোগ। তার এই মাশরুম চাষ দেখে অনেক বেকার যুবক উদ্বুদ্ধ হবে এবং এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় ভাবে একটি ভালো বাজার গড়ে উঠবে।’
সবজি বিক্রেতা সাগর আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “নওগাঁ শহরের সিও অফিস বাজারে ছোট্ট একটা দোকান বসিয়ে সেখানেই সবজি বিক্রি করি। এক বছর আগে সবজি বিক্রির ফাঁকে ইউটিউবে মাশরুম চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার একটি ভিডিও দেখি। এরপর চিন্তা করি কীভাবে অবসর সময়ে মাশরুম চাষ করে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরানো যায়। এরপর যশোরের ‘মাগুরা ড্রিম মাশরুম সেন্টার’-এ গিয়ে চার দিনের প্রশিক্ষণ নিই। প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার সময় সেখান থেকে অল্প কিছু বীজ দিয়েছিল। সেই বীজ নিয়ে এসে এক হাজার ৬০০ টাকা খরচ করে প্রথমে ৩০টি মাশরুম বীজ প্যাকেট (স্পন প্যাকেট) তৈরি করি। পরে সেখান থেকে সাত হাজার টাকার মাশরুম বিক্রি করি। তারপর পাহাড়পুর বাজারে একটি ঘর তৈরি করে সেখানে ছয় মাস মাশরুম চাষ করে অনেক টাকা লাভ দেখতে পাআ। পরে বাড়ির পাশে নিজের দুই কাঠা জায়গায় সবজি বিক্রির পাশাপাশি মাশরুম চাষ শুরু করি।” সাগর আলী আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমার খামারে ৩০০টি অয়েস্টার জাতের মাশরুম বীজ প্যাকেট (স্পন প্যাকেট) রয়েছে। সবকিছু মিলে প্রায় সাত হাজার টাকা খরচ হয়েছে। একেকটি স্পন প্যাকেট তৈরি করার ৩০ দিন পর থেকে মাশরুম আসা শুরু হয়েছে। পাঁচ দিন ধরে মাশরুম উঠতে শুরু করেছে। পাঁচ দিনেই ছয় হাজার টাকার মাশরুম বিক্রি করেছি। প্রথম অবস্থায় একটি স্পন প্যাকেট থেকে ২৪০ থেকে ৩০০ টাকার মাশরুম বিক্রি হচ্ছে। এভাবে আরও দুই মাস একেকটি স্পন প্যাকেট থেকে চার বার মাশরুম পাওয়া যাবে। বাজারে ভালো চাহিদা রয়েছে মাশরুমের। প্রতিদিন বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার দিচ্ছে। প্রতি কেজি পাইকারী ২৫০ টাকা ও খুচরা ৩০০ টাকা বিক্রি করছি। আশা করছি ভালো লাভবান হবো।’
সামনে আরও বড় পরিসরে মাশরুম বাগান করার পরিকল্পনার কথাও জানান সাগর আলী। তিনি বলেন, মাশরুম উৎপাদন করা খুব সহজ। মাশরুম চাষের জন্য এক থেকে দেড় ইঞ্চি করে খড় কাটতে হবে। এরপর সিদ্ধ করে হালকাভাবে শুকাতে হয়। যাতে চাপ দিলে পানি না ঝরে। এরপর খড়গুলো পলিথিনের প্যাকেটে রেখে তাতে মাশরুমের বীজ দিতে হবে। প্যাকেটের মুখ বন্ধ করে কয়েকটা ছিদ্র করে দিতে হবে। দিনে তিন-চার বার পানি দিতে হয়। সাধারণত ২৫-৩০ দিনের মধ্যে পলিথিনের গায়ে সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে সাদা আস্তরণ দেখা যাবে, যাকে মাইসেলিয়াম (মাশরুমের ছাতা) বলে। এরপর মাশরুম খাওয়ার উপযোগী হয়। বর্তমানে তিনি মাশরুম উৎপাদনের পাশাপাশি বীজ (স্পন) উৎপাদন করছেন। প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে তার এই মাশরুমের খামার দেখতে আসছেন অনেকেই। তাঁরা শুনছেন কীভাবে তৈরি করছেন। মাশরুম উৎপাদন করা সহজ শুনে অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন বলে জানান তিনি।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আবু হোসেন বলেন, ‘মাশরুম একটি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার। মাশরুম ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগের জন্য অনেক উপকারী। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন মাশরুম চাষ শুরু হয়েছে। চায়নিজ রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং মানুষজন ধীরে ধীরে এটি ব্যবহারে অভ্যস্ত হচ্ছে। আমি মনে করি খুব অল্প জায়গায় ও অল্প পুঁজিতে মাশরুম চাষ করা যায় এবং এটি লাভজনক একটি ব্যবসা।’