মিতু হত্যা : বাদী থেকে প্রধান আসামি স্বামী বাবুল
প্রায় পাঁচ বছর পর চট্টগ্রামের মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যায় ‘চাঞ্চল্যকর’ তথ্য সামনে নিয়ে এলো মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মিতু হত্যার পর মামলার বাদী হয়েছিলেন তাঁর স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার। পাঁচ বছর পর সেই বাবুল আক্তারই এখন মিতু হত্যা মামলার প্রধান আসামিতে পরিণত হয়েছেন। পিবিআই দাবি করেছে, মিতু হত্যাকাণ্ডে তাঁর স্বামী বাবুল আক্তার সম্পৃক্ত ছিলেন। আর বাবুলের ‘বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের’ জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
মাহমুদা আক্তার মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন আজ বুধবার চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় নতুন করে সাবেক এসপি বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। পরে বিকেলে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পিবিআই।
২০১৬ সালের ৫ জুন মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এরপর তাঁর স্বামী বাবুল আক্তার অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করেন। জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মামলায় অভিযোগ করেন তিনি। আজ এই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। আদালতের নির্দেশে গত বছর এই মামলার দায়িত্ব পায় পিবিআই।
বাবুলের ‘সোর্স’ মুসা নিয়ে পিবিআইয়ের প্রশ্ন
এই মামলার দিন যত গড়িয়েছে গতিপথও তত পাল্টেছে। ‘বাঁক পরিবর্তনের’ প্রথম সূত্রটি আসে একটি ফোন কলের ভিত্তিতে। পুলিশের দাবি, সেখানে বাবুল আক্তার একজন ‘খুনি’র সঙ্গে কথা বলেছেন। এরপরই সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারের নাম।
এ বিষয়ে আজ সকালে পিবিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রধান ও পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
বনজ কুমার মজুদার বলেন, ‘খ্যাতিমান পুলিশ অফিসার ছিলেন বাবুল আক্তার। অনেক কাজ করেছেন। তাঁর স্ত্রীকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এটি চাঞ্চল্যকর মামলা। বাবুল আক্তার বাদী হয়েছিলেন। পুরোনো মামলায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন দুজন। এতে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা আসেনি। হাইকোর্ট জানতে চেয়েছেন, কত দিন ঝুলে থাকবে। সে উত্তর খুঁজতে গিয়ে মামলা অন্যদিকে মোড় নেয়।’
বনজ কুমার আরও বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজে মুসাকে দেখা যায়। সে ছিল বাবুল আক্তারের সোর্স। মুসা নিয়মিত বাবুল আক্তারের বাসায় যেতেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে মুসা বাজারও করে দিতেন। পিবিআই জানার চেষ্টা করেছে, মুসা সোর্স ছিলেন কি না? এটাই পিবিআই প্রমাণের চেষ্টা করেছে। মিতু হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে জঙ্গি কার্যক্রমে আহত হন বলে দাবি করেন বাবুল। মৃত্যুর পর যে আচরণ, তা ছিল আপনজন হারানোর মতোই। তাই তাঁর কথা সবাই বিশ্বাস করেছিলেন।’
বনজ কুমার বলেন, ‘পিবিআই বাবুলকে ঢাকায় ডেকেছিল। গত বৃহস্পতিবার বাবুল বলেন, উনি সোমবার ৯টায় আসবেন। বাবুল পিবিআইকে কিছু প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। বিষয়গুলো আইজিপিকে জানানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও জানানো হয়।’
বনজ কুমার আরও বলেন, ‘নড়াইলে একটা লোককে আমরা পর্যবেক্ষণে নিই। তাঁর নাম গাজী আল মামুন। আরেক ব্যক্তি সাইফুল হককেও পিবিআই ডাকে। দুজনই বাবুলের বন্ধু। তাঁরা সাক্ষী হিসেবে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।’
কল রেকর্ড ধরে সন্দেহের সূত্রপাত
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেছে, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল ৭টা ৩৭ মিনিটে চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত মুসার মোবাইল ফোনে কল যায় তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তারের মোবাইল ফোন থেকে। মাত্র ২৭ সেকেন্ডের মোবাইল ফোনের কথোপকথনের রেকর্ডটিই এখন মিতু হত্যার প্রধান আলামত ও সাক্ষী।
সূত্রটি আরও দাবি করে, সালাম দিয়ে মুসা ফোনটি রিসিভ করতেই ওপার থেকে বাবুল আক্তার বলেন, ‘তুই কোপালি ক্যান?’ তিন/চার সেকেন্ড থেমে আবার বলেন, ‘বল, তুই কোপালি ক্যান? তোরে কোপাতে কইছি?’ ওপার থেকে মুসার কথা, ‘না, মানে’। এরপর বাবুল আক্তার ফোনটি কেটে দেন।
সূত্রটির দাবি, দুইটি নতুন ফোন ও নতুন সিমে এই কথোপকথনটি সারেন দুজন। মিতুকে হত্যার আগে-পরে যোগাযোগ করার জন্যই এ পদ্ধতি অনুসরণ করে বাবুল ও মুসা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এই ২৭ সেকেন্ড কলের কথোপকথনের রেকর্ড পেয়েই হত্যাকাণ্ডের ১৯ দিন পর ২০১৬ সালের ২৪ জুন রাতে মেরাদিয়ার শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার কিছুদিন পর বাবুল আক্তার পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেন।
মিতু হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল দুই সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহী ও তাবাসুম তাজনিন টাপুরকে নিয়ে মেরাদিয়ার শ্বশুরবাড়িতে উঠেছিলেন। তবে কয়েক মাস পর আলাদা বাসা ভাড়া করে সন্তানদের নিয়ে চলে যান। বাবুল আক্তার পরে মগবাজারে একটি হাসপাতালের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। পরে সেখান থেকে চাকরি ছেড়ে নিজেই ব্যবসা শুরু করেন।
‘মিতুকে গুলি করেন ওয়াসিম, কোপায় নবী’
২০১৬ সালের ২৪ জুন বাবুল আক্তারের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ওই বছরের ২৬ জুন আনোয়ার ও মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায় পুলিশ। তারা আদালতে দেওয়া জবানবন্দি দেন।
পুলিশ দাবি করেছে, জবানবন্দিতে তারা বলেন, কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসার ‘পরিকল্পনাতেই’ এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। জবানবন্দিতে ওয়াসিম জানায়, নবী, কালু, মুসা ও তিনি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন। হত্যার সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের সামনে ছিল মুসা, এরপর আনোয়ার ও একদম পেছনে ছিলেন তিনি। মোটরসাইকেলের পেছন থেকে তিনি প্রথমে মিতুকে গুলি করে।
জিইসির মোড়ে আগে থেকে ওত পেতে থাকা নবী মিতুর বুকে, হাতে ও পিঠে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। পুরো সময়টা বাবুল আক্তারের ছেলেকে আটকে রেখেছিল মুসা। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা চলে যায়। পরে এ ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই আসামি নূরুন্নবী ও রাশেদ পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। মুসাসহ দুইজন আসামি ‘গুম’ হয়ে যায়। এ মামলায় বর্তমানে ওয়াসিম ও আনোয়ার গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি। নবী, কালুসহ তিনজন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
‘তিন লাখ টাকা লেনদেন’
মামলাটি চট্টগ্রামের নগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে তিন বছর ১১ মাস তদন্তে থাকার পর গত বছরের মে মাসে পিবিআইয়ের কাছে স্থানান্তর করা হয়। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা হলেন পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা।
পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা এনটিভি অনলাইনের কাছে দাবি করেন, মাহমুদা খানম মিতুকে খুন করাতে আসামিদের তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন বাবুল আক্তার। আদালতে দেওয়া দুই সাক্ষীর জবানবন্দি ও পিবিআইয়ের তদন্তে এই তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া পিবিআইয়ের দেওয়া প্রথম মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও নতুন করা মামলায় লেনদেনের উল্লেখ আছে।
সন্তোষ কুমার চাকমা আরও দাবি করেন, ‘স্ত্রী হত্যার তিন দিন পর বাবুল আক্তার তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হককে বলেন, তাঁর লাভের অংশ থেকে তাঁকে যেন তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়। সাইফুল বিকাশের মাধ্যমে ওই টাকা গাজী আল মামুনকে পাঠান। গাজী আল মামুন ওই টাকা মুসা, ওয়াসিমসহ আসামিদের ভাগ করে দেন। তবে কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’
‘বাবুলের পরকীয়ার আলামত ক্ষুদেবার্তায়’
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের করা মামলার এজাহার অনুযায়ী, পরকীয়া প্রেম এবং এ সংশ্লিষ্ট ক্ষুদেবার্তা (এসএমএস) নিয়ে বাবুল আক্তারের সঙ্গে স্ত্রী মিতুর দাম্পত্য কলহ ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায়। এটা হত্যাকাণ্ডের সাত মাস আগের ঘটনা। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাবুল আক্তারের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে মিতু আপত্তিকর কিছু ক্ষুদেবার্তা দেখতে পান। সেখানে কক্সবাজারে একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত এক ভারতীয় নারীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের তথ্য জানতে পারেন মিতু। এ নিয়ে প্রায় প্রত্যহই বাকবিতণ্ডা হতো দুজনের।
এজাহারে মিতুর বাবা উল্লেখ করেন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাবুল আক্তার বিছানার উপর মোবাইল ফোন রেখে বাথরুমে যান। এ সময় একটি ক্ষুদেবার্তা আসে বাবুলের মোবাইলে। তখন মিতু দেখতে পান, এটি একটি আপত্তিকর বার্তা। তখন মিতু মোবাইলটির সুইচ বন্ধ করে বাসার স্টোররুমে লুকিয়ে রাখেন। এরপর বাবুল আক্তার ফোন খোঁজাখুঁজি করলে মিতু ফোনের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেন। পরদিন বাবুল আক্তার বাসা থেকে বের হলে মিতু মোবাইলটি অন করেন। এরপর ওই মোবাইল থেকে একে একে ২৯টি ক্ষুদেবার্তা পড়েন। পরে মিতু প্রমাণ হিসেবে এগুলো ছেলের ছবি আঁকার আর্ট পেপারে লিখে রাখেন। এদিকে মোবাইল না পেয়ে বাবুল আক্তার ট্র্যাকিং করে নিশ্চিত হন যে তাঁর মোবাইল ফোনটি বাসাতেই রয়েছে। এই মোবাইল ফোন নিয়ে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছে। বিষয়টি নিয়ে পরদিন মিতু ফোন দেন তাঁর মায়ের কাছে।
২০১৩ সালে বাবুল আক্তার কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেসময়ই ওই নারীর সঙ্গে বাবুল সম্পর্কে জড়ান বলে ধারণা মিতুর পরিবারের।
‘মিতু আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন’
আজ রাতে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মিতু যখন জানতে পারে অন্য একটি নারীর সঙ্গে বাবুলের অবৈধ সম্পর্ক আছে, মূলত তারপর থেকে তাদের মধ্যে পারিবারিক বিরোধ দেখা দেয়। এসব নিয়ে ওই সময় অর্থাৎ হত্যাকাণ্ডের পর, মিতু একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। একদিন বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। একদিন সারারাত সিঁড়িতে কাটিয়েছিল। এসব সবই আমরা জানতাম। আমাদেরকে মিতুই জানিয়েছিল।’
সবই তো জানতেন, তাহলে এতদিন পর মামলা কেন- এমন প্রশ্নে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সে সময় সবাই বাবুল আক্তারের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছিল। আর আসলে, আমরাও ভাবতে পারিনি, বাবুল এমন কিছু ঘটতে পারেন। ঘটনার পরে ডিবি বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, এরপর থেকে আমরা টুকটাক তথ্য জানতে পারি। যদিও কেউই আমাদের সঙ্গে খোলাসা করে কথা বলেনি। তবে এখন আমরা নিশ্চিত, বাবুলের নির্দেশেই এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে।’