‘মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বাতিলের এখতিয়ার জামুকার নেই’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাওয়া রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলের কোনো এখতিয়ার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) নেই বলে মন্তব্য করেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম।
আজ বৃহস্পতিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘জেড’ ফোর্সের ‘এ’ ও ‘বি’ কোম্পানির কমান্ডার হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এই মন্তব্য করেন। ‘জেড’ ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত মেজর শাহজাহান ওমর বীর উত্তম। তিনিও হাফিজের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন।
হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম বলেন, “জামুকার এগুলো কাজ না, জামুকা হলো কে ভাতা পাবে কি পাবে না…। কিন্তু বীর উত্তম, স্বাধীনতার ঘোষক, ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক, সেক্টর কমান্ডার, সেনাবাহিনী প্রধান, জেনারেল, প্রেসিডেন্ট… তাদের ব্যাপারে এখতিয়ার আছে? হু ইজ জামুকা? কে? চিনি কেউ এদের? কোথায় জিয়াউর রহমান আর কোথায় এগুলো!”
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করি, জনগণকে আর হাস্যস্পদ করবেন না। এই উদ্যোগ যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে আপনি আপনার পিতাকে অসন্মান করছেন। এই খেতাব নিল কী গেল- তাতে কিছু আসে যায় না, তিনি মৃত এখন। খেতাব নিয়ে নিলেও জিয়াউর রহমান জিয়াউর রহমানই থাকবেন, লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে, অনাগত ভবিষ্যতের কাছে তিনি এই দেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রূপেই ইতিহাসে চিহ্নিত থাকবেন এবং জনগণের হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসন তাঁর চিরঅম্লান থাকবে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তৎকালীন উপসেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান কখনও সম্পৃক্ত ছিলেন না দাবি করে হাজিফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তো বিচার হয়েছে। কই কোনো সাক্ষী, কোনো ব্যক্তি কেউ কী বলেছে যে, উনি (জিয়াউর রহমান) এই ধরনের হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন বা এটা করেছেন।’
বিএনপি সরকারের সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের দেউলিয়াত্ব শেষপর্যায়ে পৌঁছে গেছে, জাতিকে দেওয়ার আর কিছুই নেই। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস হচ্ছে। জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ করার জন্য আজকে জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের মতো একজন ব্যক্তি সম্পর্কে এই ধরনের অলীক তথ্য জাতির কাছে হাজির করেছে। এটা দুঃখজনক। জিয়াউর রহমান কোনো ধরনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। হি ওয়াজ অ্যা ন্যাশনাল হিরো।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম বলেন, ‘কী কারণে হঠাৎ করে জামুকা একটা এমন প্রস্তাব করল আমার বোধগম্য নয়। জুমকা কী? মুক্তিযুদ্ধের সময় তিন ধরনের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একটা হচ্ছে মিলিটারি ফোর্স, আরেকটা হলো ফ্রিডম ফাইটার, তিন নম্বর হলো যুদ্ধের শেষ দিকে বিএলএফ নামে এটা সংগঠন গঠন করা হয়েছিল; যেটার বাংলা মুজিব বাহিনী।
শাহজাহান ওমর বলেন, “আমরা যারা মিলিটারি ফোর্স আমাদের কন্ট্রোল করে ‘কোর’ নামে একটা সংস্থা আছে- সেন্টার অফিসার্স রেকর্ড অফিস। আমাদের সঙ্গে জামুকার কোনো সম্পর্ক নাই। জামুকা হলো ফ্রিডম ফাইটাদের ভাতা, তাদের সন্মানী, তাদের সুযোগ-সুবিধা কীভাবে অধিক থেকে অধিকতর দেওয়া যায়- দিস ইজ দ্য জব অব জামুকা। জুমকার কোনো এখতিয়ার নেই আমাদের মিলিটারি অফিসার যারা মুক্তিযোদ্ধা তাদের বিষয় কিছু বলা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার।”
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘জামুকা তাদের নিজস্ব বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা তাদের এখতিয়ার বহির্ভুত এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী যে কথা বলেছেন এটাও তাঁর এখতিয়ার বহির্ভুত। এখন প্রশ্ন দাঁড়াল- বীর উত্তম, বীরশ্রেষ্ঠ, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক- মামাবাড়ির আবদার নাকি, না ছেলের হাতের মোয়া? যখন চাইবেন মামার বাড়ির হারটা কেড়ে নেবেন! এটা তো আমরা যুদ্ধ করে অর্জন করেছি। জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেছেন, হি ডিক্লিয়ার ওয়ার এবং নিজে যুদ্ধ করেছেন। তিনি এই মেজর হাফিজসহ সিলেট সেক্টর, সিলেট শহর মুক্ত করেছেন।’
শাহজাহান ওমর আরও বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের কল পেয়ে আমরা যুদ্ধে নেমেছি। জিয়াউর রহমান তাঁর ফ্যামিলি ছেড়ে, বাচ্চা রেখে যুদ্ধে গেছেন। আমরাও আমাদের ফ্যামিলিকে বাঘের মুখে রেখে যুদ্ধ করেছি। ইন্ডিয়ায় এসেছি, সৈন্য নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছি আগস্ট মাসে। ৯ ডিসেম্বর আমার নেতৃত্বে বরিশাল মুক্ত হয়েছে। আমি তিনবার গুলিবিদ্ধ হয়েছি। আমাকে বীর উত্তম দিয়েছে। কেউ আমাকে এই খেতাব দয়ায় দেয়নি। এই খেতাব কেড়ে নেওয়ার আপনারা কে?’
‘দুই বাঙালি এই ভারতবর্ষে যুদ্ধ করেছেন। একজন ভারতবর্ষের নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, আরেকজন হলেন শহীদ জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কয়েকদিন পরে আরো কিছু লোক বলবে, তিনি এই দেশের নাগরিকও না। তাতেও জিয়াউর রহমানের কিছু আসে যায় না। বীর উত্তম নিলেও তাঁর কিছু আসে যায় না। জিয়া ইজ জিয়া, তিনি বাংলাদেশের একাত্তরের সাত কোটি মানুষের অন্তরে গাঁথা, তাঁর অবদান হৃদয়ে গাঁথা।’
মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দেওয়া হয়েছিল। গত মঙ্গলবার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সভায় সেই খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিএনপি বলছে, এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে করা হয়েছে।
তবে গতকাল গাজীপুরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘খবরটা অনেকেই হয়তো ঠিকমতো পরিবেশন করেন নাই। বঙ্গবন্ধুর চার হত্যাকারীর বিরুদ্ধে আদালতে রায় ঘোষিত হয়েছে। তাদের রাষ্ট্রীয় সনদ বা সম্মাননা সেটা বাতিল করা হয়েছে। আরো চারজনের নাম এসেছে দালিলিক প্রমাণসহ। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। এদের মধ্যে জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী রয়েছেন। সেজন্য আমরা একটা কমিটি করে দিয়েছি, আগামী সভায় এ বিষয়ে কী কী দালিলিক প্রমাণ আছে সেটা দাখিল করার জন্য। এবং তাহলে তাদের সম্মাননা বাতিল করা হবে।’
এদিন মন্ত্রী আরো বলেন, ‘কী কী দালিলিক প্রমাণ আছে, মুখে বললে তো হবে না। দালিলিক প্রমাণ যদি থেকে থাকে সেগুলো আগামী সভায় উপস্থাপনের জন্য বলা হয়েছে।’