মুন্সীগঞ্জে দুই আ.লীগনেতার ৩৫ বছরের বিরোধে ঝরেছে ৫ প্রাণ
মুন্সীগঞ্জ সদরের চরাঞ্চল আধারা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে টানা ৩৫ বছরের বিরোধে পাঁচজনের প্রাণ গেছে। এর মধ্যে গতকাল সোমবার সংঘর্ষে একজন নিহতের ঘটনা ঘটে। ইউনিয়নের বকুলতলা ও সোলারচর গ্রামে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আধারা ইউনিয়নের সোলারচর ও বকুলতলা গ্রাম ঘুরে এ তথ্য জানা গেছে।
গতকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আধারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সুরুজ মেম্বার ও ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী হোসেন গ্রুপের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কয়েক দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে গতকাল রাত ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান মনির হোসেন মোল্লা (৭০)। তার বাড়ি বকুলতলা গ্রামে।
এদিকে নিহত মনির হোসেনের বাড়িতে শোকের মাতম শেষ না হতেই ফের সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সোলারচর ও বকুলতলা গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
জানা যায়, আধারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সুরুজ মেম্বারের সমর্থক সোলারচর গ্রামের জান্নাত (২০) নামে এক যুবককে ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী হোসেনের লোকজন ধরে নিয়ে মারধর করে হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আধারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিবদমান দুটি গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় মারামারি, ককটেল বিস্ফোরণ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় উভয় পক্ষের ১০-১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়। শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। বাড়িঘরও ভাঙচুর করা হয়। দুই গ্রুপের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে বকুলতলা গ্রামে মনির হোসেন মোল্লা গুলিবিদ্ধ হন।
স্থানীয়রা জানায়, আধারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুরুজ মিয়া বেপারি ও একই ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী হোসেনের মধ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে ৩৫ বছর ধরে। গতকাল সকালে জান্নাতকে মারধরের ঘটনায় সুরুজ মেম্বারের পক্ষে বুদা, বিল্লাল ও রফিকুল সশস্ত্র অবস্থায় বকুলতলা গ্রামে হামলা চালিয়ে শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। ওই সময় আওয়ামী লীগনেতা আলী হোসেনের লোকজন বোরহান সরকার, রঞ্জন, আঞ্জু সরকার, মুজিব মেম্বার সশস্ত্র অবস্থায় প্রতিপক্ষের ওপর গুলি ছুড়লে উভয়পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। এতে দুই পক্ষের ১০-১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ মনির হোসেন মোল্লাকে আহত অবস্থায় মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখানে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগনেতা সুরুজ মেম্বার ও আলী হোসেন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন মজিবুর রহমান। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৯৯৯ সালে দুলাল মাঝি, ২০০০ সালে আক্তার হোসেন ও ২০১৩ সালে রুবেল মিয়া নিহত হন। সর্বশেষ গতকাল দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত মনির হোসেন মোল্লাকে নিয়ে অপরাজনীতিতে উঠেপড়ে লেগেছে একটি পক্ষ। তারা আধারা ইউনিয়নের সাবেক পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী অসুস্থ আব্দুল হক মোল্লাকে ফাঁসানোর পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ ঘটনায় আব্দুল হক মোল্লা বলেন, আমি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর থেকে গ্রামে যাই না। দীর্ঘদিন ধরে কিডনিজনিত সমস্যায় ভুগছি। তিন মাস ধরে দেশের বাইরে চিকিসাৎধীন রয়েছি। একটি পক্ষ আমাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছে।
এদিকে গুরুতর আহত জান্নাতের মা নূর বানু বলেন, ‘আমার ছেলেকে আলি হোসেনের লোকজন ধরে নিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে বেধড়ক মারধর করে। পরে খবর পেয়ে আমরা তাঁকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। আমার ছেলের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মনির হোসেন মোল্লা নিহতের ঘটনায় সদর থানায় কোনো মামলা হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তার মরদেহ বকুলতলা গ্রামের বাড়িতে এনে সন্ধ্যায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। দুই ছেলেই প্রবাসে রয়েছেন।
নিহত মনির হোসেনের পুত্রবধূ সামিয়া বেগম জানান, তার শ্বশুর নামাজ আদায় করে বাড়ি থেকে বের হন। সে সময় দুই দলের মধ্যে ছোটাছুটি ও ককটেল বিস্ফোরণ হচ্ছিল। এ ছাড়া গুলিও করছিল। তারমধ্যেই তার শ্বশুর গুলিবিদ্ধ হন।
নিহত মনির হোসেনের স্ত্রী মঞ্জু বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী কোনো দলাদলি করে না। তাকে কেন গুলি করে মারল। যেভাবে আমার স্বামীর বুকে গুলি করছে, তাতেই উনি পইর্যা গেছেন। লোকজন ধরাধরি করে ঢাকায় নিয়া গেলে মারা যান উনি। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই।’
এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অর্থ) সুমন দেব বলেন, ঘটনার পর পরই ওই গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তি কী ধরনের বিস্ফোরকে মারা গেছেন সে বিষয়ে তদন্ত করা হবে। সংঘর্ষে অস্ত্র ব্যবহার হওয়ার বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করছে। যদি ব্যবহার হয়ে থাকে সেসব অস্ত্র উদ্ধারে আমাদের তৎপরতা থাকবে। এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।