যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নিজেদের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া, বিবিসিকে প্রধানমন্ত্রী
“আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজেদের ব্যাপারে আরও মনোযোগী হওয়া। তাদের দেশের কী অবস্থা? তাদের উচিত শিশুদের জীবন রক্ষা করা। তারা নিজেদের লোকজনের ব্যাপারে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারা যেসব অভিযোগ করেছে, আমরা তাদের কাছে প্রমাণ চেয়েছিলাম, তারা দেয়নি।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাম্প্রতিক যুক্তরাজ্য সফরের সময় বিবিসির ইয়ালদা হাকিমের সঙ্গে একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন৷ প্রায় আধঘণ্টা ধরে চলা ওই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ, বিচার বহির্ভূত হত্যা, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, গণতন্ত্র ও রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন শেখ হাসিনা৷ সোমবার (১৪ মে) রাতে বিবিসির বাংলা বিভাগ এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে৷
বিবিসিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশে অটোক্রেসি বা একনায়কতন্ত্রের যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করা হয়, সেটি নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না বলেই বাংলাদেশের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে৷ তাঁর দাবি, গত ১৪ বছর ধরে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকায় দেশে অসাধারণ উন্নয়ন হয়েছে৷ শুধু গত ১৪ বছর ধরেই দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে, তাই আমরা উন্নতি করতে পারছি।”
বিবিসির ইয়ালদা হাকিমের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলাপচারিতায় দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে৷ বিবিসি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র কেন বাংলাদেশের একটি বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন?
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “যে বাহিনীর ওপর তারা (যুক্তরাষ্ট্র) নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটা তাদের পরামর্শেই ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ তাদের সব প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল৷ যেভাবে তারা বাহিনীটাকে তৈরি করেছে, তারা তো সেভাবেই কাজ করছে বলে আমার বিশ্বাস৷ তাহলে কেন তারা এই নিষেধাজ্ঞা দিল? এটা আমার কাছেও বিরাট এক প্রশ্ন৷”
শেখ হাসিনার কাছে ইয়ালদা হাকিম জানতে চান, তাহলে কেন তারা এটা করেছে বলে তিনি মনে করেন? উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি জানি না, হয়তো তারা (যুক্তরাষ্ট্র) আমার কাজ অব্যাহত থাকুক তা চায় না, আমি বাংলাদেশের জন্য যেসব উন্নতি করেছি, সেটা তারা হয়তো গ্রহণ করতে পারছে না৷ এটা আমার অনুভূতি৷ একটা পর্যায়ে সন্ত্রাস সব দেশের জন্য সমস্যা হয়ে উঠেছিল৷ আমাদের দেশে আমরা সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করেছি৷ এরপর মাত্র একটা ঘটনা ঘটেছে৷ আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রাখতে কঠোর পরিশ্রম করেছে৷”
নিষেধাজ্ঞা জারির আগে ২০১৮ সালে ৪৬৬ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে৷ ২০১৯ সালে ৩৮৮ মানুষ এভাবে নিহত হয়েছে৷ আর ২০২০ সালে নিহত হয়েছে ১৮৮ জন৷ কিন্তু নিষেধাজ্ঞার পর এই সংখ্যা মাত্র ১৫ জনে নেমে এসেছে৷ এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “যেসব সংখ্যা তারা উল্লেখ করেছে, সেগুলো তারা প্রমাণ করতে পারেনি৷ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব হত্যাকাণ্ড আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করেনি৷ কারণ আমরা প্রমাণ চেয়েছিলাম, সেগুলো তারা পাঠিয়ে দিক, আমরা তদন্ত করে দেখব৷”
ডয়চে ভেলের একটি তথ্যচিত্রে দাবি করা হয়, র্যাবের দুজন গোপন তথ্য ফাঁস করে বলেছেন, এসব হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসেছে৷ এই তথ্য তুলে ধরা হলে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি জানি না, তারা কীভাবে এটা করেছে৷ কিন্তু আমেরিকায় কী ঘটছে, আপনি দেখতে পাচ্ছেন৷ সেখানে প্রায় প্রতিদিন একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে৷ এমনকি স্কুল, শপিংমল ও রেস্তোরাঁয় হত্যাকাণ্ড ঘটছে৷ এমনকি স্কুলশিক্ষার্থীরা, সাধারণ মানুষ অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সশস্ত্র ব্যক্তির হাতে নিহত হচ্ছে। আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজেদের ব্যাপারে আরও মনোযোগী হওয়া৷ তাদের দেশের কী অবস্থা? তাদের উচিত শিশুদের জীবন রক্ষা করা৷ তারা নিজেদের লোকজনের ব্যাপারে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷”
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে গত এপ্রিলের মাঝামাঝি শেখ হাসিনা এক বক্তব্যে বলেছেন, আমেরিকা বাংলাদেশের ক্ষমতায় পরিবর্তন আনতে চায়৷ এই বক্তব্যের পক্ষে কী প্রমাণ আছে, বিবিসির পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “আমার কাছে একটা বড় প্রশ্ন হলো—কেন তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করল? যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের সন্ত্রাস মোকাবিলার জন্য কাজ করছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তখন তারা লঙ্ঘনকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে; যারা ভুক্তভোগী, তাদের পক্ষে নয়৷”
বিবিসি বলেছে, সরকারের তথ্যেই জানা গেছে বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২০ হাজারের মতো মামলা হয়েছে, সাত হাজারের বেশি বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয়েছে৷ এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “হ্যাঁ৷ কিন্তু তারা কী করেছিল? তারা মানুষ হত্যা করেছে; তারা ককটেল ছুড়েছে৷ তারা পাবলিক বাসে আগুন দিয়েছে৷ তিন হাজার ৮০০ পাবলিক বাসের ভেতরে যাত্রীদের রেখেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে৷ তারা সাধারণ মানুষ হত্যা করেছে; ট্রেন, লঞ্চ, প্রাইভেটকারে আগুন দিয়েছে৷ যারা হত্যা করেছে, মানুষকে নির্যাতন করেছে, দুর্নীতি করেছে; এই জন্য তারা শাস্তি পেয়েছে৷ আমি বুঝতে পারি না-তারা যেসব অপরাধ করেছে, কেন এসব (মানবাধিকার) সংগঠন সেটা দেখতে পাচ্ছে না!”
বিবিসি বলেছে, গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৯৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে৷ ভোটের এই হার মিসরের অনেক সামরিক শাসকের চেয়েও বেশি৷ এটা অনেকটা ভ্লাদিমির পুতিনের ভোটের মতো৷ এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “কেন নয়? আমাদের কাজের জন্যই মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছে। আমরা তাদের জন্য কাজ করেছি৷ আমাদের ১৭০ মিলিয়ন মানুষ রয়েছে৷ আমাদের জনগণ রাজনৈতিক অধিকারের ব্যাপারে সচেতন৷ আমরা ক্ষমতায় আসার পর দারিদ্র্য কমেছে, খাদ্য নিরাপত্তা বেড়েছে; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ণসহ সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়েছে৷ তাহলে মানুষ কেন (আমাদের) ভোট দেবে না?”