যে সব উপকরণে তৈরি হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু
বাংলাদেশের স্বপ্নের সেতু পদ্মা সেতু। দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের জন্য এটি যেমন আশীর্বাদ তেমনি বাঙালি জাতির জন্য গর্বের। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এ সেতুকে নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা। পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর আগেই দুর্নীতির অভিযোগে বড় ধরনের ধাক্কা খায় সরকার। সেতু তৈরির অর্থের অন্যতম যোগানদাতা বিশ্বব্যাংকসহ অন্যরা সরে দাঁড়ায়। তবে সরকার প্রধান শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্ত আর মনোবলের কারণে এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় পদ্মা সেতু। নিজস্ব অর্থায়নের এ সেতুকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সক্ষমতার প্রতীক। কেউ বলছেন, সততার প্রতীক। আবার অপমানের প্রতিশোধও বলছেন অনেকেই।
চলমান সংসদের আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা বলেছেন, পদ্মা সেতু নিয়ে দেশ-বিদেশে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু নিজেদের টাকায় এই সেতু নির্মাণ করে ষড়যন্ত্রকারীদের সমুচিত জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক এবং অপমানের প্রতিশোধ। এই সেতু শুধু সেতু নয়, এটি প্রকৌশলজগতে এক বিস্ময় বলেও মন্তব্য করেন তারা।
স্বপ্নের এ পদ্মা সেতু নিয়ে এনটিভি অনলাইনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রথম পর্ব। প্রথম পর্বে থাকছে কী কী উপকরণে তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতু।
মেধাস্বত্ব
পদ্মা সেতু তৈরিতে কাজ পায় চীনের ‘চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি’। তবে এতে চায়না বাংলাদেশসহ অন্তত ২০টি দেশের মেধা কাজ করেছে। অর্থাৎ ২০ দেশের বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ান ও কর্মীর মেধা–শ্রমে এই পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু তৈরিতে উপকরণ
পদ্মা সেতু তৈরিতে ৩০টি উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে দেশি-বিদেশি উভয় ধরনের উপকরণই রয়েছে। সেতু বিভাগের তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী, মূল সেতুর কাজে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লুক্সেমবার্গ, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়া নানা উপকরণের জোগান দিয়েছে। সেতুর কর্মকর্তারা বলছেন, এর বাইরে সেতুর কাজে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসসহ আরও অনেক দেশের যন্ত্র ও কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়েছে।
দেশীয় উপকরণ
দেশীয় উপকরণের মধ্যে রয়েছে রড, সিমেন্ট, বালু, বৈদ্যুতিক কেবল, পাইপ, ডিজেল, বিটুমিন, জিও ব্যাগ ইত্যাদি। এ ছাড়া নদীশাসন, সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে রড, সিমেন্ট, বালু ও পাথরের পুরোটাই ছিল দেশি উপকরণ।
সেতু বিভাগের হিসাবে, পদ্মা সেতুতে সিমেন্ট লেগেছে আড়াই লাখ টনের বেশি। এর সবই দেশে উৎপাদিত। বাংলাদেশে তৈরি রড ব্যবহৃত হয়েছে ৯২ হাজার টনের বেশি। সেতুতে বালু লেগেছে সাড়ে তিন লাখ টন। বিটুমিন লেগেছে দুই হাজার টনের বেশি। নদীতীর রক্ষায় ২৫০ কেজি ওজনের জিও ব্যাগ বসানো হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ। এগুলোর সবই বাংলাদেশ থেকে কেনা হয়েছে। দেশে তৈরি বিদ্যুতের কেবল ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় পৌনে তিন লাখ মিটার এবং পাইপ ১ লাখ ২০ হাজার মিটার।
বিদেশি উপকরণ
মাটিতে বেশি ওজন বহনে সক্ষম এক ধরনের বিশেষ সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে পদ্মা সেতুতে। যাকে বলা হয় মাইক্রোফাইন বা অতিমিহি সিমেন্ট। সিঙ্গাপুর থেকে আনা হয়েছে এমন দুই হাজার টন সিমেন্ট। যা পদ্মা সেতুর পাইলিংয়ের ওপরের অংশে ব্যবহার করা হয়েছে। ইউরোপের লুক্সেমবার্গ থেকে এসেছে ৯ হাজার টনের বেশি রেলের গার্ডার (স্ট্রিনজার)।
সেতুর পানি নিষ্কাশনের পাইপ ও পাইল বসানোর জন্য ব্যবহৃত পলিমার এসেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। এর মধ্যে পাইপ এসেছে ৩৯ হাজার মিটার। আর পলিমার ব্যবহৃত হয়েছে ২৪৯ টন।
কংক্রিটের পথের ওপর প্রথমে দুই মিলিমিটারের পানি নিরোধক একটি স্তর বসানো হয়েছে, যা ওয়াটারপ্রুফ মেমব্রেন নামে পরিচিত। ৫৬০ টন পানি নিরোধক উপকরণ এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। সেতুর পাশে রেলিংয়ের অ্যালুমিনিয়ামও এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকল্পে ব্যবহৃত ৫-২০ মিলিমিটারের সোয়া পাঁচ লাখ টন পাথর এসেছে। এ ছাড়া আমিরাত থেকে কিছু অ্যালুমিনিয়ামও আনা হয়েছে।
তিন ধরনের বিয়ারিং
পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত হয়েছে তিন ধরনের বিয়ারিং। এ সব বিয়ারিং এসেছে চীন থেকে। এর মধ্যে অন্যতম হল ভূমিকম্পের সময় সেতুটিকে সুরক্ষিত রাখার ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিয়ারিংয়ের ওজন ২৫ টনের মতো। এক সেট বিয়ারিং প্রায় ১০ হাজার টন ওজনের ভার বহন করতে সক্ষম। সেতুতে এমন বিয়ারিং বসানো হয়েছে ৯৬ সেট। সেতু বিভাগ বলছে, পদ্মা সেতুর আগে পৃথিবীর আর কোনো সেতুতে এমন বিয়ারিং ব্যবহৃত হয়নি। এসব বিয়ারিং ভূমিকম্প প্রতিরোধব্যবস্থা পদ্মা সেতুকে রিখটার স্কেলে প্রায় ৮ মাত্রার ভূমিকম্প থেকে রক্ষা করবে।
পদ্মা সেতুতে আরেক ধরনের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে, যা সেতুটির বিভিন্ন অংশকে যুক্ত রাখতে সহায়তা করছে। পদ্মা সেতুতে এমন ৩ হাজার ৫৫৬ সেট বিয়ারিং রয়েছে।
এছাড়া তাপ ও চাপে সংকোচন-প্রসারণের জন্য সম্প্রসারণশীল জোড়া (এক্সপানশন জয়েন্ট) বিয়ারিং। এ কাজে ২৮ সেট বিয়ারিং স্থাপন করা হয়েছে। সব সেতুতেই এ ধরনের বিয়ারিং থাকে।
পাইল
পদ্মা সেতুতে দুই ধরনের পাইল বসানো হয়েছে। মূল সেতু অর্থাৎ নদীর অংশে তিন মিটার ব্যাসার্ধের পাইপের মতো (ভেতরে ফাঁকা) স্টিলের পাইল বসানো হয়েছে ২৬৪টি। এসব পাইল এসেছে চীন থেকে। এগুলোর ওজন ছিল প্রায় ১ লাখ ৬২ হাজার টন।
স্প্যান
পদ্মা সেতুতে স্টিলের স্প্যান বসানো হয়েছে ৪১টি। চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হেবেই প্রদেশের কারখানায় স্টিলের প্লেট দিয়ে এসব স্প্যান তৈরি হয়েছে। স্প্যানগুলোতে ১ লাখ ২৬ হাজার টন স্টিলের প্লেট লেগেছে।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থা
পদ্মা সেতু তৈরিতে প্রয়োজন ছিল বিদ্যুৎ। এ বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য সোয়া চার কোটি লিটার ডিজেল পোড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ।