রাজশাহীতে এমপির বিরুদ্ধে অধ্যক্ষকে মারধরের অভিযোগ
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে সরকার দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে। ঈদের আগে গত ৭ জুলাই রাজশাহী নগরীর নিউ মার্কেট সংলগ্ন সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত চেম্বারে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এসময় গোদাগাড়ী উপজেলার বিভিন্ন কলেজের আরও কয়েকজন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনার সময় উপস্থিত অপর এক কলেজ অধ্যক্ষ জানান, গোদাগাড়ি উপজেলার একটি কলেজে নতুন নিয়োগ পাওয়া অধ্যক্ষ উপজেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদেরও দায়িত্ব পেয়েছেন। তার স্ত্রী অত্যন্ত সুন্দরী এবং সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে গোটা উপজেলায় পরিচিত। নগরীর নিউ মার্কেট সংলগ্ন এমপির মালিকানাধীন থিম ওমর প্লাজার একটি ফ্লাটে স্ত্রীসহ সেই অধ্যক্ষ থাকেন। একই ভবনে এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীরও বাসা ও অফিস। গোদাগাড়ী উপজেলার সর্বত্র এমন কথা ছড়িয়েছে যে, সুন্দরী স্ত্রীর সাথে এমপির ভালো সম্পর্ক থাকায় কলেজ অধ্যক্ষের পাশাপাশি উপজেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ বাগিয়ে নিয়েছেন ওই অধ্যক্ষ। রাজাবাড়ি কলেজের কয়েকজন শিক্ষকও সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তাদের এ ধরনের কথোপকথন কে বা কারা মুঠোফোনে রেকর্ড করে সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর মুঠোফোনে পাঠিয়ে দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক অধ্যক্ষ জানান, কলেজ শিক্ষকদের কথোপকথন এমপির কাছে পৌঁছানোর পর তিনি মাটিকাটা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল আউয়াল রাজুকে দিয়ে ফোন করে উপজেলার বিভিন্ন কলেজের আটজন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষকে গত ৭ জুলাই রাত ৯টায় থিম ওমর প্লাজায় এমপির চেম্বারে ডেকে নেন। সেখানে এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী রাজাবাড়ি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজার কাছে জানতে চান, তার কলেজের কয়েকজন শিক্ষক অপর একটি কলেজের অধ্যক্ষ ও দলীয় নেতার স্ত্রীকে নিয়ে তাকে জড়িয়ে অশ্লীল যেসব কথাবার্তা বলেছেন, প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি তার কী ব্যবস্থা নিয়েছেন।
জবাবে অধ্যক্ষ সেলিম বিষয়টি তার জানা নেই জানালে এমপি তার ফোনের রেকর্ড অন করে বিষয়টি অধ্যক্ষ সেলিমকে শুনতে বলেন। এরই মধ্যে এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে জাপটে ধরে বেধড়ক মারধর শুরু করেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব অধ্যক্ষদের একজন সেলিম রেজাকে কয়েক মিনিট পর এমপির কব্জা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চেম্বার থেকে বের করে আনেন। পরে আহত অধ্যক্ষ সেলিম রেজা অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সাঈদ আহমেদের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে নগরীর রায়পাড়া এলাকায় নিজের বাসায় ফেরেন। ঘটনার পর থেকে তিনি ক্ষোভে লজ্জায় বাসা থেকে আর বের হননি।
এ বিষয়ে জানতে অধ্যক্ষ সেলিম রেজার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তার পারিবারিক সূত্র বলেছে, এ ঘটনায় পরে গত সোমবার বিকেলে এমপির ঘনিষ্ঠ গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক বেলাল উদ্দিন সোহেল অধ্যক্ষের বাসায় যান। তিনি হোয়াটসঅ্যাপে এমপির সঙ্গে অধ্যক্ষের কথা বলিয়ে দেন। এ সময় এমপি ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। পরিবারের সদস্যরা বলেন, সংসদ সদস্য ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করায় তাদের কোনো অভিযোগ নেই।
তবে সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কলেজের পরিচালনা পর্ষদ গঠনকে কেন্দ্র করে অধ্যক্ষ ও তাঁর লোকজন নিজেরাই হাতাহাতি শুরু করলে তাঁর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি মিটমাট হয়েছে। দলের মধ্যে থাকা বিরোধী পক্ষ তার বিরুদ্ধে অধ্যক্ষকে মারধরের অপপ্রচার চালিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা হাসিল করতে চায় বলে দাবি করেন সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী।
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোদাগাড়ী উপজেলার কয়েকজন অধ্যক্ষ জানান, গত ৭ জুলাই এমপি যে কয়েকজন অধ্যক্ষকে তার চেম্বারে ডেকে নিয়েছিলেন। তারা অধ্যক্ষের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর কাছের লোক। এ কারণে তাদের সামনে এমপি এমন ঘটনা ঘটালেও ঘটনার সময় উপস্থিত কেউ এখনো মুখ খোলেননি। তারা বলেন, এর আগেও সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী গোদাগাড়ী উপজেলার এক কলেজ অধ্যক্ষকে প্রকাশ্যে মারধর করলেও সে ঘটনাতেও এমপির কিছু হয়নি। উল্টো পরবর্তীতে ওই অধ্যক্ষকে অন্য অভিযোগ এনে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
রাজশাহী জেলা কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা দাবি করেছেন, ভুক্তভোগী অধ্যক্ষ সেলিম রেজার সাথে তাঁর কথা হয়েছে। সেলিম রেজার বরাত দিয়ে শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, ‘আরও সাত-আটজন অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের সামনে সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী সেলিম রেজাকে কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় এবং একপর্যায়ে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়েছেন। মারধরের সময় অন্য অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষরা চুপচাপ ছিলেন।’
অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, ‘ওমর ফারুক চৌধুরী তার নির্বাচনি এলাকার কলেজের শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে চাপে রাখেন। তিনি গোদাগাড়ী-তানোরের কোন শিক্ষককে সমিতিতে আসতে দেন না। তাঁর ভয়ে কেউ আসতে পারেন না। এখন মারধরের বিষয়টি জানানো হলে আমি বলেছি আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিতে হবে। তাহলে বিষয়টা নিয়ে আমি মাঠে নামব। তা না হলে না। অভিযোগ না করলে পরে আবার পালিয়ে যাবে। অতীতে এ রকম বহু ঘটনা দেখেছি।
ঘটনাটি ঘটেছিল রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানা এলাকায়। এই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘সাংবাদিকরা ফোন করছেন। তাঁদের কাছেই এ ধরনের ঘটনা শুনলাম। কিন্তু ভুক্তভোগী অধ্যক্ষ আমাদের কিছু জানাননি। যতক্ষণ তিনি লিখিত অভিযোগ না করবেন, ততক্ষণ আমরা এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।’