রূপগঞ্জ অগ্নিকাণ্ড : কিশোরগঞ্জের শ্রমিকদের বাড়িতে শোকের মাতম
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড লিমিটেডের জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহত কিশোরগঞ্জের শ্রমিকদের বাড়িতে চলছে স্বজনদের আহাজারি। স্বজনহারাদের বুকফাটা আর্তনাদ ও আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে জেলার চারটি উপজেলার ১৫টি গ্রামের পরিবেশ। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের কেউ লাশ নিয়ে ফিরেছেন, কেউ আগুনে পুড়ে যাওয়া স্বজনের মরদেহ খুঁজে না পেয়েই বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাঁদের অনেকেই এখন লাশ পাওয়ার আশায়।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডে নিহত কিশোরগঞ্জের শ্রমিকেরা হচ্ছে সদর উপজেলার বৌলাই দক্ষিণ রাজকুন্তি গ্রামের আব্দুল কাদিরের মেয়ে আমেনা, শেওড়া গ্রামের কাইয়ুমের মেয়ে খাদিজা, জালিয়া গ্রামের মাহতাব উদ্দিনের স্ত্রী শাহানা বেগম, কালিয়ারকান্দা গ্রামের চাঁন মিয়ার ছেলে নাজমুল ইসলাম, বড়খালের পাড়ের আজিজুল হকের মেয়ে মোছা. রহিমা আক্তার, রঘুনন্দনপুরের মালেকের মেয়ে মাহমুদা বেগম, ব্রাহ্মণকান্দি গ্রামের নিজাম উদ্দিনের মেয়ে শাহানা বেগম, করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের উত্তর কান্দাইল গ্রামের মিনা আক্তার (৩৩), মথুরাপাড়া গ্রামের খোকন মিয়ার স্ত্রী জাহানারা (৩৫), আব্দুল কাইয়ুমের স্ত্রী পাখিমা (৩৪), তাহের উদ্দিনের ছেলে নাঈম (১৮), দক্ষিণ নানশ্রীর মাসুদের ছেলে সোহাগ (১৩), মুলামখারচরের সুজনের মেয়ে ফাতেমা আক্তার, চাতল গ্রামের সুরুজ আলীর মেয়ে ফারজানা আক্তার, সাঁইটুটা গ্রামের মো. স্বপন মিয়ার মেয়ে শায়লা আক্তার, কটিয়াদী উপজেলার সহশ্রাম ধূলদিয়া ইউনিয়নের গৌরিপুর গ্রামের বাচ্চু মিয়ার মেয়ে তাছলিমা বেগম, চান্দু মিয়ার মেয়ে রাবেয়া বেগম ও মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী গ্রামের মো. সেলিমের মেয়ে সেলিনা বেগম। তবে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, নিহত শ্রমিকের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার দানাপাটুলি ইউনিয়নের পূর্বকালিয়াকান্দা গ্রামের দিনমজুরের ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র নাজমুল ইসলাম করোনা পরিস্থিতির কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় কিছু বাড়তি রুজির আশায় দুই মাস আগে ওই কারখানায় শ্রমিকের চাকরি নেয়। তার বাবা চাঁন মিয়া জানান, নাজমুলের ইচ্ছা ছিল করোনাকালে কিছু টাকা আয় করতে পারলে তার পরিবার ভালোভাবে খেয়ে পরে চলতে পারবে। কিছু টাকা তার পড়ালেখার কাজেও ব্যয় করতে পারবে। কিন্তু নিয়তি তাকে সে সুযোগ দেয়নি। কারখানার আগুনে সে জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেছে। নাজমুলের লাশ খুঁজে ফিরছেন তার বাবা চাঁন মিয়া।
ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের উত্তর কান্দাইল গ্রামের মিনা আক্তারের লাশ নিয়ে স্বামী হারুন মিয়া ওই দিনই গভীর রাতে বাড়ি ফেরেন। মিনা আক্তারের এমন মৃত্যুতে এখনও শোকে মুহ্যমান পুরো পরিবার। নিহতের স্বামী হারুন মিয়া বলেন, ‘...অন্তত লাশটি বুঝে পেয়েছি।’ কিন্তু, মৃতদেহ পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ায় অনেকের সে সুযোগটিও নেই।
একই উপজেলার মথুরাপাড়ার নিখোঁজ শ্রমিক পাখিমা আক্তারের দুই সন্তান দশম শ্রেণির ছাত্রী আছমা ও ছোট ছেলে জুয়েল মায়ের জন্য কেঁদেই চলেছে। স্বজনেরা জানান, চার বছর ধরে ওই কারখানায় কাজ করতেন পাখিমা এবং তাঁর বড় ছেলে মোস্তাকিম। তবে, রাতের পালায় ডিউটি থাকায় ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যায় ছেলে মোস্তাকিম। ঘটনাস্থল এবং হাসপাতালে ছোটাছুটি করেও লাশ পাননি তাঁর স্বামী আব্দুল কাইয়ুম।
একই গ্রামের খোকন মিয়ার স্ত্রী জাহানারা এবং তাহের উদ্দিনের একমাত্র ছেলে নাঈম পাখিমার সঙ্গে ওইখানে কাজ করতেন। জাহানারার স্বামী খোকন মিয়া এবং নাঈমের বাবা তাহের উদ্দিন জানান, তাদের দুজনের লাশ অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
একই চিত্র জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের মথুরাপাড়া, সদরের দানাপাটুলী ইউনিয়নের কালিয়ারকান্দা, যশোদল ইউনিয়নের ব্রাহ্মণকান্দি, বৌলাই ইউনিয়নের রঘুনন্দনপুর গ্রামে সব নিহত স্বজনদের বাড়িতেই। এ অবস্থায় নিহতদের বাড়িতে এলাকাবাসী এসে ভিড় জমাচ্ছেন। স্বজনদের শান্তনা দিচ্ছেন কেউ কেউ।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা অনেকেই অভিযোগ করেছেন, কারখানায় আগুনের পর গেট তালাবদ্ধ না থাকলে হয়তো তারা বেঁচে যেত। তারা নিহতদের মরদেহ ফিরে পেতে সরকারের সহায়তা চেয়েছেন। কিশোরগঞ্জ সদরের দানাপাটুলি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এ বি এম জালাল উদ্দিন জানান, কারখানা মালিকের গাফিলতি ও গেট বন্ধ থাকার কারণে শ্রমিকদের করুণ মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের কঠোর বিচার ও নিহতের পরিবারদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের জোর দাবি জানান তিনি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জেলার কতজন শ্রমিক এ দুর্ঘটনায় মারা গেছে, সে বিষয়ে এখনও কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে জেলার করিমগঞ্জ, সদর, কটিয়াদী ও মিঠামইন উপজেলার অনেকেই নিখোঁজ রয়েছে। যারা নিখোঁজ, তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।