রোহিঙ্গা সন্দেহে আটক মৃণাল ৩ বছর কারাভোগের পর মুক্ত
স্বাভাবিক কথা বলতে পারেন না। দেখতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মতো। মুখে পাতলা দাড়ি। বয়স অনুমান ৪৪ বছর। একটি জিডির সূত্র ধরে সদর থানা পুলিশ তাকে রাস্তা থেকে আটক করে। পরে পাঠানো হয় কারাগারে। কেটে যায় দুই বছর নয় মাস। কেউ তার খোঁজ নিতে আসে না। পরিচয়হীন হয়েই কারাগারে থেকে যান তিনি। আজ সোমবার বিকেলে ঝিনাইদহ জেলা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে তাকে।
তাকে নিয়ে সব সময় টেনশনে ছিল কারা কর্তৃপক্ষ। অবশেষে গণমাধ্যমের কল্যাণে মিলেছে তার পরিচয়। তিনি নীলফামারী জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ চাওড়া গ্রামের যতীন্দ্র নাথ রায় ও শোভারাণীর বড় ছেলে মৃণাল চন্দ্র রায়।
কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন জেল সুপার মো. আনোয়ার হোসেন, জেলার মো. রফিকুল ইসলাম, ডেপুটি জেলার মো. সাইফুল ইসলাম, এনটিভির স্টাফ রিপোর্টার ও জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মিজানুর রহমান, সাধারণ সম্পাদ শেখ সেলিম (চ্যানেল আই), সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মেদ নাসিম আনসারী (যমুনা টিভি), দপ্তর সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ ( ঢাকা পোস্ট) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জেলা কারাগারের সুপার মো. আনোয়ার হোসেন জানান, মৃণাল জন্মগতভাবে বাক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। মা মারা যান ২০০৭ সালে। বাবা আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র সংসার পেতেছেন। মৃণালের ছোট ভাই ভবেশ চন্দ্র রায়ও প্রতিবন্ধী। মামার কাছে আশ্রয় হয়েছিল তাদের। আট বছর আগে হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে হারিয়ে যান মৃণাল। তাকে সন্ধান করার কেউ না থাকায় ভবঘুরে হয়ে এখানে সেখানে ঘুরতে থাকেন তিনি। ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নগরবাথান এলাকা থেকে রোহিঙ্গা সন্দেহে পরিচয়হীন হিসেবে তাকে আটক করে পুলিশ। এরপর ঝিনাইদহ সদর থানার একটি জিডির সূত্র ধরে আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। অবশেষে পরিচয় মিলেছে তার।
মো. আনোয়ার হোসেন আরও জানান, কারা কর্তৃপক্ষ মানবিক বিষয়টি ঝিনাইদহের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বৈজয়ন্ত বিশ্বাসের নজরে আনেন। তিনি (বিচারক) নিজ উদ্যোগে মৃণালের আসল ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। বিষয়টি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গত ৩১ জুলাই অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট টেকনাফ, কক্সবাজার, উখিয়া ভাসানচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছবি পাঠানোর নির্দেশ জারি করেন। একই আদেশে আটক লোকের সঠিক ঠিকানা খুঁজে পেতে নোয়াখালী, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার ও এপিবিএন কমান্ডারদের নির্দেশ দেন তিনি। এর আগে মানসিক ভারসাম্যহীন কি না, তা পরীক্ষা করাতে খুলনা মেডিকেলেও নেওয়া হয়েছে মৃণালকে। জেলা নির্বাচন অফিসে ওই ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার হাতের ছাপ গ্রহণ করে বাংলাদেশের নাগরিক কি না, তাও যাচায় করা হয়। এমনকি বিচারকের উপস্থিতিতে ভিডিও কলের মাধ্যমে টেকনাফ থানা পুলিশের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা দোভাষীর সঙ্গে কথা বলানো হয়। কিন্তু দোভাষীও ওই মৃণালের কথা বুঝতে পারেন না।
জেল সুপারসহ সবাই হতাশ হয়ে পড়েন এবং আইনি জটিলতায় মৃণালকে সারা জীবন করাগারেই থাকতে হবে বলে ধরে নেন তারা। তবে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বৈজয়ন্ত বিশ্বাস হাল ছাড়েননি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রচারের উদ্যোগ নেন। অবশেষে পরিচয় মিলে যায় তার।
পরিবারের দেওয়া তথ্য মতে, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মৃণালের জন্ম (নিবন্ধন সূত্রে) ১৯৮১ সালের ১১ আগস্ট।
অবশেষে মৃণালকে তার মামা শ্রী চিরেন্দ্র নাথ রায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাকে পেয়ে খুশি এলাকার মানুষ। তারাও এসেছিল ঝিনাইদহ জেলা কারাগারে।
মৃণালের এলাকাবাসী মো. নুরুল ইসলাম তাকে (মৃণাল) ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আদালত, গণমাধ্যম ও কারা কর্তৃপক্ষের ভূমিকার কথা মনে রাখবেন বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
মৃণালকে বিদায় দেওয়ার সময় কারারক্ষীরা বারবার তাকে ছুয়ে দেখেছে। কত বন্দি আসে আর যায় কিন্তু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মৃণাল ছিল ব্যতিক্রম। আজ বিকেলে তাকে অশ্রুসিক্ত হয়ে বিদায় জানান কারারক্ষীরা। এ সময় স্বাভাবিক কথা বলতে না পারলেও মাথা নেড়ে হাসি দিয়ে ভালোবাসার জবাব দিয়েছেন মৃণাল।
শেষ পর্যন্ত মৃণাল বাড়ি ফিরে গেছেন এতেই গণমাধ্যমকর্মীদের আনন্দ। কারা কর্তৃপক্ষের জিপে করে স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয় তাকেসহ সবাইকে। মৃণালের বিদায় বেলায় কারাগারের ঘণ্টা ঢং ঢং শব্দে বেজে উঠে জানান দেয় বিকেল ৫টা বাজার।