লম্বু মোশারফ অপরাধ জগতের ত্রাস, দাবি র্যাবের
রাজধানীর মোহাম্মদপুরসহ পার্শ্ববর্তী আমিনবাজার, তুরাগ, হাজারীবাগ, কেরাণীগঞ্জ ও সাভারের ত্রাস মো. মোশারফ। মোশারফ বাহিনীর প্রধান তিনি। এলাকাভেদে তাকে লম্বু মোশারফ, গলাকাটা মোশারফ অথবা গাঙচিল মোশারফ নামও রয়েছে। এসব এলাকায় ডাকাতি-ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অপহরণ, ভূমিদখল ও মাদকের কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধ তার ইশারায় (নেতৃত্বে) চলত।
মো. মোশারফের দলে ২৫-৩০ জন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী রযেছে। লম্বু মোশারফের নির্দেশেই তারা নানা অপকর্ম ঘটাত। মোশারফের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যাচেষ্টা, ছিনতাই, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্র, মাদক কারবার, ধর্ষণ, অপহরণ, পুলিশ অ্যাসল্টসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে। তবে নিজের গ্রেপ্তার এড়াতে বেশ কিছু দিন আত্মগোপনে ছিলেন তিনি।
গতকাল রোববার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে মোশারফসহ তার ৫ সহযোগীকে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, মাদকসহ গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। আজ সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মো. বিল্লাল ওরফে বিল্লাল হোসেন ওরফে চোরা বিল্লাল (৩০), মোহন ওরফে বাইক মোহন (৩১), সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু (৪৪), রুবেল ওরফে ডাকাত রুবেল ওরফে ট্রলার রুবেল (৩৩) ও মো. সুমন মিয়া ওরফে সুমন হোসেন (৩০), অভিযানে তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, চার রাউন্ড গুলি, তিনটি বড় ছোরা, দুটি চাপাতি, দুটি চাকু, একটি চাইনিজ কুড়াল, একটি দা, একটি ফ্রেমসহ হেসকো ব্লেড, একটি গ্রিল কাটার, একটি কাটার প্লাস, ৪২৩ পিস ইয়াবা, পাঁচটি মোবাইল জব্দ করা হয়৷
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সন্ত্রাসী লম্বু মোশারফ নিজের গ্রেপ্তার এড়াতে বিভিন্ন সময়ে মোহাম্মদপুর, কেরাণীগঞ্জ, কাফরুলসহ বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপন করে থাকতেন। মোহাম্মদপুর এলাকা র্যাবের এক অভিযানে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ কবির হোসেনকে তার সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়। কবিরকে জিজ্ঞাসাবাদে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ লম্বু মোশারফের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়, পরে ধারাবাহিক অভিযানে গত রোববার মোশারফ ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, সন্ত্রাসী লম্বু মোশারফ রাজধানীর মোহাম্মদপুর, সাভার, হাজারীবাগ, তুরাগ কেরাণীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় নৌপথ, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড ও হাউজিং প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের নেতৃত্ব দিতেন।
খন্দকার আল মঈনের দাবি, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায, ২০১৭ সালে গাঙচিল গ্রুপের প্রধান আনারের মৃত্যুর পর গাঙচিল গ্রুপ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়। ওই সময় লম্বু মোশারফ গাঙচিল গ্যাংয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। এরপর লম্বু মোশারফ ও গ্যাঙের একটি অংশের নেতৃত্বে চলে যায়। তারা মোহাম্মদপুর, আমিনবাজার ও তার আশপাশের এলাকায় ও নৌপথে চাঁদাবাজি, ডাকাতি-ছিনতাইসহ মাদক কারবার পরিচালনা শুরু করে। লম্বু মোশারফের নেতৃত্বে এই সন্ত্রাসী দলের সদস্যরা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে বিভিন্ন এলাকায় জমি দখল, হাউজিং-এ চাঁদাবাজি, নৌপথে চাঁদাবাজি, মার্কেট ও বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও মাদক কারবার চালাতেন। শুধু তাই নয়, তারা বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে বালু ভর্তি ট্রলার, ইটের কার্গো ও অন্যান্য জাহাজ আটকিয়ে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করতেন। এ ছাড়াও তারা সাভার ও তুরাগ এলাকার বিভিন্ন ইটভাটার মালিকের কাছ থেকেও মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায় করতেন। কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলে লম্বু মোশারফ বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখাতেন এবং হত্যার হুমকিও দিতেন। অনেককে রাতের অন্ধকারে ধরে নিযে যেতেন।
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, গাঙচিল বাহিনী রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে এক অজানা ভয় ও আতঙ্কের নাম ছিল। কৌশলে মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে কিশোর গ্যাং গ্রুপও নিয়ন্ত্রণ করতেন লম্বু মোশারফ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গ্রেপ্তার লম্বু মোশারফ ভোলা জেলার বোরহানউদ্দীন উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। ১৯৯০ সালে জীবিকার প্রয়োজনে সে ঢাকায় আসেন। প্রথমে সে বেবি ট্যাক্সি ও সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। পরে সে হাউজিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করেন। ২০০০ সালে রাজধানীর কাফরুল থানাধীন এলাকায় ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে ঢোকেন। সেই থেকে গাঙচিল বাহিনীর প্রধান আনার অন্যতম সহযোগী হয়ে যায়। ২০১৭ সালে আনারের মৃত্যুর পর গাঙচিল বাহিনী বিভিন্নভাগে বিভক্ত হয়। বাহিনীর মূল অংশের নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন লম্বু মোশারফ।
র্যাব জানায়, উচ্চতায় লম্বা হওয়ায় সে ‘লম্বু মোশারফ’ এবং মারামারির সময় ভূক্তভোগীকে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার কারণে তার নাম হয় ‘গলাকাটা মোশারফ’। ইতোপূর্বে গাঙচিল বাহিনীর সদস্য হওয়ায় তার নামের আগে যুক্ত হয় গাঙচিল মোশারফ।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, লম্বু মোশারফের সহযোগী বিল্লাল হোসেন ২০০৬ সালে মুন্সিগঞ্জ থেকে পরিবারসহ ঢাকায় আসেন। ঢাকায় গার্মেন্টস ও গাড়ির চালকের সহকারীর পর ২০১৭ সালে মোশারফের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ভালো চুরি করতে পারতেন বলে তার নাম হয়ে যায় চোরা বিল্লাল। গ্রেপ্তার সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন। ২০১৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সময়ে লম্বু মোশারফের সঙ্গে যোগ দেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আসামি রুবেল ২০০৬ সাল থেকে মোহাম্মদপুর এলাকায় ট্রলারনৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ শুরু করে। ২০১৮ সালে লম্বু মোশারফের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে সে অপরাধ জগতে পাড়ি জমায়। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি ডাকাতির সময়ে সে নৌকা বা ট্রলার চালনা করত। দলের অপর সদস্য সুমন মিয়া ঢাকার বাবুবাজার এলাকার বাসিন্দা। সে বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসে চাকরি ও ডিস লাইন লাগানোর কাজ করত। ২০২০ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরির সময় লম্বু মোশারফের দলে যোগ দেয়। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টা, মাদক, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে একাধিক মামলা রয়েছে।