‘সময়মতো অক্সিজেন পেলে আব্বা বেঁচে যেতেন’
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা আক্রান্ত বাবার শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় তাঁকে নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন কামাল হোসেন। মাইক্রোবাস থেকে নেমেই জরুরি বিভাগ থেকে তাঁকে পাঠানো হয় ২২ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে অক্সিজেন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতেই মারা যান কামাল হোসেনের বাবা। বাবার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে কামাল বলছিলেন, ‘আর পাঁচটা মিনিট আগে এলে আব্বা হয়তো বেঁচে যেত। সময়মতো গ্যাস (অক্সিজেন) পেলে আমার আব্বা বেঁচে যেতেন।’
কামাল হোসেনের বাড়ি নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার বীরডাউন গ্রামে। গত শনিবার বিকেলে ৫টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ২২ নম্বর ওয়ার্ডে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান তাঁর বাবা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কিংবা উপসর্গ নিয়ে কামাল হোসেনের বাবার মতো যাঁরা হাসপাতালে আসছেন, তাদের এখন সবার অক্সিজেন লাগছে। হাসপাতালে যে আটটি ওয়ার্ডে পাইপলাইনের মাধ্যমে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই ব্যবস্থা ছিল, সেগুলো রোগীতে ভর্তি। এখন বারান্দা এবং বিছানায় রোগী রাখার প্রস্তুতি চলছে। বেড ছাড়াও এখানে অক্সিজেন সরবরাহ করা যায় কিনা, তা নিয়েও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘করোনার প্রথম ধাক্কা এবং এখনকার মধ্যে পার্থক্য দেখছি। আগে সব রোগীর অক্সিজেনের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু এখন অন্তত ভর্তির সময় শতভাগ রোগীর অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। দুএকদিন থাকার পর হয়তো আর লাগছে না। কিন্তু শুরুতেই যে সবার অক্সিজেন লাগছে, এটা সত্যিই ভীতিকর। এ রকম রোগীর চাপও বাড়ছে।’
রামেক হাসপাতালের মোট এক হাজার ২০০ শয্যার মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ভর্তি ছিল ২২৪ জন করোনা রোগী। এদের মধ্যে রাজশাহীর ১০১ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৯৬ জন, নওগাঁর ৯ জন, নাটোরের সাতজন এবং পাবনার ছয়জন। আজ সকাল থেকে আগের ২৪ ঘণ্টায় করোনা ওয়ার্ডে নতুন করে ভর্তি হয়েছে ২৯ জন। এর মধ্যে রাজশাহীর ১৪ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১১ জন, নওগাঁর তিনজন এবং পাবনার একজন। ২৪ ঘণ্টায় করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীঅন অবস্থায় মারা গেছে নয়জন। এদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচজন, রাজশাহীর দুইজন, নওগাঁ ও পাবনার একজন করে।
চিকিৎসকরা জানান, করোনা ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেশি বলে সব রোগীকে ভর্তিও নেওয়া হচ্ছে না। যাদের অক্সিজেনের মাত্রা কম, কেবল তাদেরই ভর্তি করা হচ্ছে। অন্যদের বাড়িতেই চিকিৎসা নিতে বলা হচ্ছে। সুতরাং হাসপাতালে সব রোগীকেই অক্সিজেন নিতে দেখা যাচ্ছে। আর এটা দেখে উদ্বীগ্ন হয়ে যাচ্ছেন স্বজনেরা। উন্নত চিকিৎসার আশায় তারা হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) সিরিয়াল দিচ্ছেন।
রাজশাহী সড়ক ও জনপথ বিভাগের মালি রানার মা মজিজন বিবি হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন। তিনি জানান, তিন দিন অপেক্ষার পর তাঁর মা আইসিইউ পেয়েছেন। এই তিন দিন ওয়ার্ডে থাকা অবস্থায় প্রায় ২৫ হাজার টাকার ওষুধ-ইনজেকশন কিনেছেন। কিন্তু আইসিইউ না পাওয়ার কারণে ভরসা পাচ্ছিলেন না। তবে গত শনিবার আইসিইউ পাওয়ার পর সোমবার দিবাগত রাতে চিকিকৎসাধীন অবস্থায় রানার মা মারা যান।
হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস বলেন, ‘আরও পাঁচটা ভেন্টিলেটর পাওয়া গেলে পাঁচটা আইসিইউ বেড বাড়ানো যাবে। সে কারণে ঢাকায় পাঁচটা ভেন্টিলেটরের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। রোগীর এতো চাপ যে এখন বেডই শেষ হয়ে এসেছে। এ কারণে এক নম্বর ওয়ার্ডটিকেও করোনা রোগীদের জন্য ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই ওয়ার্ডটিতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই ব্যবস্থা আছে।’
আর হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘শুধু এক নম্বর ওয়ার্ড দিয়েই রোগীর বাড়তি চাপ সামাল দেওয়া যাবে না। তাই করোনা ওয়ার্ডগুলোর মেঝে এবং বারান্দাতেও রোগী রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু বারান্দায় আবার সরবরাহ করা অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে না। তাদের সিলিন্ডারের অক্সিজেন দিতে হবে। এই অক্সিজেনের চেয়ে সেন্ট্রাল লাইনের অক্সিজেনেই রোগীদের বেশি সুবিধা হয়। তারপরও উপায় নেই বলে এটা করতে হবে।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী আরও বলেন, ‘করোনা ও উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে যাঁরা ভর্তি হচ্ছেন, তাদের প্রত্যেকের অক্সিজেন লাগছে। প্রতিদিন এখানে চার হাজার লিটারের মতো অক্সিজেন লাগছে। অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে আরও অক্সিজেন লাগলে আরও দেবে। কিন্তু রোগী রাখার জায়গা হচ্ছে না।’