সিনহা হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিলেন ওসি প্রদীপের নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার চতুর্থ দফায় দ্বিতীয় দিনে তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এ নিয়ে এই মামলায় মোট ২০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম জানান, আজ বুধবার সকাল সোয়া ১০টায় জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে এ সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। আজ প্রথমে সাক্ষী হামজালালকে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের আইনজীবীসহ তিন আসামির আইনজীবী জেরা করেন। এ ছাড়া সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান, টেকনাফ উপজেলার হোয়াইকং ইউনিয়নের লম্বাবিল গ্রামের গৃহবধূ বেবি বেগম ও ছালেহ আহমেদ আদালতে জবানবন্দি দেন। আগামী ধার্য তারিখে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা বেবি বেগমকে জেরা করবেন। আদালত আজ সন্ধ্যা ৭টায় মুলতবি ঘোষণা করে আগামী ১০, ১১ ও ১২ অক্টোবর এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।
পিপি ফরিদুল আলম জানিয়েছেন, আদালতে জবানবন্দি দানকালে সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান জানিয়েছেন ওসি প্রদীপের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্রসফায়ারের নিউজ করায় তাকে নানাভাবে হুমকি দেন। একপর্যায়ে তিনি সপরিবারে ঢাকায় চলে যান। ওসি প্রদীপ ঢাকার মিরপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে কক্সবাজারে নিয়ে আসেন এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখান। একপর্যায়ে ওসি প্রদীপ তাকে টেকনাফ থানায় নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালান। তার চোখে মরিচের গুঁড়া দিয়ে থেঁতলে দেন। ওই অবস্থায় তাকে কক্সবাজার সমিতিপাড়ায় তার বাসায় নিয়ে এসে চার হাজার পিস ইয়াবা, অস্ত্র ও বিদেশি মদের বোতল ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে একে একে ছয়টি মামলা দিয়ে জেলে পাঠান। ওসি প্রদীপ ও তার বাহিনীর নির্যাতনে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলেও ওসি প্রদীপ তাতে বাধা দেন।
আদালতে সাক্ষ্যদানকালে গৃহবধূ বেবি বেগম জানান, ওসি প্রদীপ টেকনাফ থানায় দায়িত্ব পালনকালে তার বাড়িতে ইয়াবা তল্লাশির নামে তার স্বামীকে আটক করে নিয়ে যান। ওসি প্রদীপ তাদের কাছে ৪০ লাখ টাকা দাবি করেন। তারা ১৫ লাখ টাকা দিলেও ওসি প্রদীপ তাকে ছাড়েননি। পরে তার মেয়েকেও থানায় আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণ করেন। একপর্যায়ে তার মেয়েকে ইয়াবা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে জেলে পাঠান। এসব বিষয়ে তৎকালীন পুলিশ সুপারের কাছে বিচার দিতে গেলে ওসি প্রদীপ কৌশলে তাকেও গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠান। জেলখানায় মেয়ে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণের কাহিনি তাকে জানান।
একই এলাকার দিনমজুর ছালেহ আহমেদও আদালতে জবানবন্দি দানকালে ওসি প্রদীপের ক্রসফায়ারের নানা কাহিনি তুলে ধরেন।
এর আগে গত ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত মামলার প্রথম দফার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এতে সাক্ষ্য দেন মামলার বাদী ও সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস এবং ২ নম্বর সাক্ষী ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গে একই গাড়িতে থাকা সঙ্গী সাহেদুল সিফাত। পরে দ্বিতীয় দফায় চার দিনে চারজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। তৃতীয় দফায় তিন দিনে আটজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে কড়া পুলিশি পাহারায় ওসি প্রদীপসহ মামলার ১৫ আসামিকে প্রিজনভ্যান করে আদালতে আনা হয়।
পিপি বলেন, মামলায় সাক্ষ্যদানের জন্য ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ২৯ জনকে আদালত নোটিশ দিয়েছিলেন। গত ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনে মামলার বাদী ও ২ নম্বর সাক্ষী জবানবন্দি প্রদান করেন। মামলায় দ্বিতীয় দফায় চার দিনে চারজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। তৃতীয় দফায় তিন দিনে সাক্ষ্য নেওয়া হয় সিনহার মৃতদেহের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকসহ আটজন প্রত্যক্ষদর্শীর। চতুর্থ দফায় মোট সাতজন আদালতে তাদের জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত বছরের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
এ ঘটনায় গত বছর ৫ আগস্ট সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় লিয়াকত আলীকে। আদালত মামলার তদন্তভার দেন র্যাবকে। ঘটনার ছয় দিন পর ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতসহ সাত পুলিশ সদস্য আত্মসমর্পণ করেন।
সিনহার মৃত্যুর পর পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় একটি এবং রামু থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করে।
পরে র্যাব পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন সাক্ষী এবং শামলাপুর চেকপোস্টে দায়িত্বরত আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় টেকনাফ থানা পুলিশের সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে। সর্বশেষ গত ২৪ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন টেকনাফ থানার সাবেক এএসআই সাগর দেব।
গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের তৎকালীন দায়িত্বরত সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
গত ২৭ জুন আদালত ১৫ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এতে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে।