সৎ জীবনে ফিরতে কালুকে সুযোগ দেওয়া উচিত : অস্ট্রেলিয়ার ব্লগার ডেম্যান্ট
কালু নামে এক ব্যক্তির কাছে হেনস্তা ও উত্ত্যক্তের শিকার হন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ও ট্রাভেল ব্লগার লিউক ডেম্যান্ট। রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজারে ‘স্ট্রিট ফুড’ খেতে খেতে ভিডিও করার সময় পরিচয় হয় দুজনের। ঘটনার পরিক্রমায় সেখান থেকে হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছানো অবধি পিছুই ছাড়ছিলেন না কালু। এই ঘটনায় আজ সোমবার (৩ এপ্রিল) গ্রেপ্তার হন তিনি। পরে ২০০ টাকা জরিমানা গুনে আদালত থেকে ছাড়া পান। সেই কালুকে নিয়ে এবার কথা বললেন ভুক্তভোগী ব্লগার। তিনি বলেন, ‘সৎ জীবনে ফিরতে কালুকে সুযোগ দেওয়া উচিত।’
ব্লগার লিউক ডেম্যান্ট তার ইউটিউব চ্যানেলে ৩৯ মিনিট এক সেকেন্ডের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন। ‘অ্যাভোয়েড দিস ম্যান ইন বাংলাদেশ! বিডি’ শিরোনামের ওই ভিডিওর ২৫ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে একটি সড়কের পাশের খাবার বিক্রির স্থানে পৌঁছান। সেখানে ২৫ মিনিট ২৭ সেকেন্ডে বিক্রেতার সঙ্গে সালাম বিনিময় করেন। পরে বিক্রেতাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কী?’ বিক্রেতা বুঝতে না পারায় কাজে মগ্ন হন। এমন সময় কথা বলতে দেখা যায় কালুকে। ভিডিওতে তখন সময় ২৫ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড। তিনি বলেন, ‘কেক।’
এরপর কথা এগোতে থাকে ব্লগার ও কালুর। কালু মোটামুটি ইংরেজিতে কথা চালাতে থাকেন। জিজ্ঞেস করেন, ‘কোন দেশ থেকে এসেছেন?’ ব্লগার বলেন, ‘অষ্ট্রেলিয়া।’ কালু বলেন, ‘ওহ! খুব ভালো। মেলবোর্ন?’ ব্লগার বলেন, ‘না, সিডনি।’ কালু বলেন, ‘সিডনি খুবই সুন্দর জায়গা।’
ব্লগার লিউক ডেম্যান্ট কালুকে ধন্যবাদ জানান। পরে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’ একইসঙ্গে কালুও জিজ্ঞেস করেন, ‘কতোদিন থাকবেন?’ ডেম্যান্ট জানান, দুই সপ্তাহ।
এরপরই কালু কেনাকাটা করেছেন কিনা জিজ্ঞেস করেন ডেম্যান্টকে। বিভিন্ন মার্কেটের কথা বলতে চেষ্টা করেন। সেখানে তাকে নিতে প্রলুব্ধ করতে থাকেন। ডেম্যান্ট শপিং করবেন না বলে জানান। শুধু খাবারের কথা বলেন। তিনি ডিমের তৈরি একটি খাবার খেতে খেতে কালুকেও একটি খেতে বলেন। তিনি একটি নেনও।
পরে ভিডিওতে দেখা যায়, কালু ডেম্যান্টকে বিভিন্ন মার্কেট সম্বন্ধে বলছেন। কাছাকাছি একটি মাছ বাজার, মাংসের বাজার আছে বলেও উল্লেখ করেন। এরপর তাদের মধ্যে বেশ কথা এগোয়। একপর্যায়ে ডেম্যান্ট যে খাবারটি খান, সেটি কীভাবে তৈরি হয় তা দেখান। পরে তার পাশে আরও উৎসুক জনতা দাঁড়ালে তিনি তার ইউটিউব চ্যানেলটি নিজের মুঠোফোনে দেখান।
পরে ডেম্যান্ট খাবার বিক্রেতাকে তার নাম বাংলা এবং ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করেন। এসময় সবাইকে হাস্যোজ্জ্বল দেখায়। ডেম্যান্ট বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করেন, কত বছর ধরে তিনি এই কাজ করছেন? আরও নানা তথ্য জানতে চান তিনি। পরে প্রশংসা করেন বিক্রেতার। বলেন, ‘কঠোর পরিশ্রমী মানুষ।’ এরপর ডেম্যান্ট ওই বিক্রেতাকে ৫০০টাকা দেন এবং বলেন, বাকি টাকা ‘ফেরত দেওয়া লাগবে না।’
তারপর থেকেই ঘুরে যায় মোড়। কালু ওই বিক্রেতাকে বলেন, ‘বাকিটা আমি লইলমু!’ এসময় বিক্রেতা বলেন, ‘বাকিটা তাকে (কালু) দিয়ে দেব?’ বাংলা বুঝতে না পেরে ডেম্যান্ট বলেন, ‘না, আমি বাকি টাকা ফেরত চাই না।’ পরে কালু ডেম্যান্টকে বলেন, ‘আমি কি বাকি টাকা থেকে নিতে পারি?’ তখন ডেম্যান্ট বলেন, ‘তুমি কি ওই টাকা চাও?’ কালু জানান, ‘চাই।’ পরে ডেম্যান্ট বলেন, ‘হ্যাঁ, তুমি যদি চাও নিতে পার।’
তখন বিক্রেতা বলেন, ‘হাফ হাফ (অর্ধেক অর্ধেক)।’ শুনে ডেম্যান্ট বিক্রেতাকে বলেন, ‘তুমি লাভের অংশটি আলাদা করে নিতে পার।’
এরপর ডেম্যান্ট কালুকে ধন্যবাদ জানান। বলেন, ‘অনুবাদ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’ পরে বিক্রেতার সঙ্গে করমর্দন করে তিনি চলে যেতে থাকেন। এসময় কালুকে ওই বিক্রেতার কাছ থেকে টাকা চাইতে দেখা যায়।
পরে কালু বলেন, ‘চলেন যাই।’ ডেম্যান্ট বলেন, ‘না, আমি আমার হোটেলে যেতে চাই।’ কালু বলেন, ‘ঠিক আছে, এটা খুব কাছেই।’ তখনও ডেম্যান্টকে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়।
এরপর ডেম্যান্টের সঙ্গে হাঁটতে থাকেন কালু। নানাভাবে তাকে মাংসের ও মাছ বাজারে নিতে চান। ডেম্যান্ট রাজি হন না। তিনি কালুকে এড়াতে চাইলেও কালু তার সঙ্গেই হাঁটতে থাকেন। ডেম্যান্ট হোটেলে যাওয়ার রাস্তায় চলতে চান বললেও কালু তাকে বাজারমুখো করতে চায়। এরপর কালুর কাছ থেকে নিজেকে একপ্রকার মুক্ত করে হাঁটতে হাঁটতে খাবারের অভিজ্ঞতার কথা বলতে থাকেন। কিন্তু কালু তাকে অনুসরণ করতে থাকে। একপর্যায়ে মাছের বাজার পার হন। এরপর ডেম্যান্ট হোটেলে যেতে চাইলে তার কাছ থেকে টাকা চাইতে শুরু করেন কালু। তিনি বলেন, ‘আমাকে কিছু টাকা দেন। খাবার কিনব। আপনার জন্য দোয়া করব।’
এসময় ডেম্যান্ট বলেন, ‘আমি আপনাকে টাকা দিয়েছি।’ পরে তিনি চলে যাওয়ার জন্য করমর্দন করেন। কিন্তু কালু ছাড়ে না কিছুতেই। চাইতে থাকে টাকা। বলেন, ‘কিছু চাল কিনব। আর অন্যান্য।’ কিন্তু টাকা দিতে রাজি না হলেও পিছু ছাড়েন না কালু। চলতে থাকেন তার সঙ্গে। বলতে থাকেন, ‘আমার স্ত্রী ও সন্তানরা ক্ষুধার্ত।’ পরে দুঃখ প্রকাশ করেন ডেম্যান্ট। বলেন, 'কতো দরকার?' কালু বলেন, ‘৫০০ টাকা।’ একপর্যায়ে কিছু টাকা দেন ডেম্যান্ট। কিন্তু ৫০০টাকা চান কালু। বলেন, ‘দুদিন ধরে আমার পরিবার না খেয়ে আছে। দয়া করে আমাকে ৫০০ টাকা দেন। আমি দোয়া করব।’ এরপর কালুকে ডেম্যান্ট বলেন, ‘আপনি আমাকে একটু একা থাকতে দেবেন?’ কিন্তু ৫০০ টাকার নাছোড়বান্দা কালু পিছু ছাড়তেই চায় না।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হন কালু। আজ সোমবার (৩ এপ্রিল) বিকেলে ট্যুরিস্ট পুলিশের ফেসবুক পেজে কালুকে নিয়ে করা এক পোস্টের কমেন্টে লিউক ডেম্যান্ট বলেন, ‘মো. আব্দুল কালুকে (৬০) আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।’
ডেম্যান্ট আরও বলেন, ‘প্রিয় বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ...মো. কালু আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। আমি এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও দেখেছি। তাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। আমি আশা করছি, সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে ও তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করা হবে। আমি চাই না সে এ বিষয়টি নিয়ে আর ভোগান্তিতে পড়ুক। আমি বিশ্বাস করি, সৎ জীবনে ফিরে আসার জন্য কালুকে দ্বিতীয় একটি সুযোগ দেওয়া উচিত। ধন্যবাদ।’
এদিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় লিউক ডেম্যান্টকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে আটক দোভাষী আব্দুল কালুকে ২০০ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অনাদায়ে তাকে একদিনের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়। তবে তিনি জরিমানার টাকা পরিশোধ করে সিএমএম আদালতের হাজতখানা থেকে মুক্ত হয়েছেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশের ফেসবুক পেজে কালুর একটি ছবি এবং ভিডিও লিংকের স্ক্রিনশট শেয়ার করে ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা সব সময় আমাদের অতিথিদের, অর্থাৎ বিদেশি পর্যটকদের আমাদের সুন্দর বাংলাদেশে স্বাগত জানাই।’
পোস্টটিতে ডেমান্ট তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে কমেন্টে বলেন, ‘সকল দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশকে বিশেষ ধন্যবাদ। আমি সত্যিই আপনাদের দ্রুত প্রতিক্রিয়ার প্রশংসা করছি।’
ডেমান্ট কালুকে আঘাত না করার অনুরোধ জানিয়ে আরও লিখেছেন, ‘আপনি যদি লোকটিকে বাংলাদেশে দেখেন, আমার অনুরোধ—দয়া করে তাকে আঘাত করবেন না বা খারাপ কিছু বলবেন না। প্রত্যেকেই জীবনে ভুল করে এবং তার পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।’