হবিগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী মৎস্যমেলা, বাঘাইড়ের দাম লাখ টাকা
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী মৎস্যমেলা। তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে এবার মৎস্যমেলায় ঢল নামে ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের। বিভিন্ন এলাকা থেকে খোয়াই নদীর পূর্বপ্রান্তের এই গ্রামে আজ রোববার সকাল থেকেই মৎস্যমেলায় নামে জনস্রোত।
ঐতিহ্যবাহী এ মৎস্যমেলায় কেউ যান মাছ কিনতে, আবার কেউ যান বড় বড় মাছ দেখতে। এ যেন এক মিলনমেলা। মাছের পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্যের পসরা বসে এই মেলায়। মেলা উপলক্ষে ওই এলাকায় বিরাজ করে যেন ‘ঈদের আনন্দ’।
পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে প্রায় ২০০ বছর ধরে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল গ্রামে ঐতিহ্যবাহী মৎস্যমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে গত দুই বছর এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়নি। দুই বছর পর আজ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে এ মৎস্যমেলা। দুই শতাধিক দোকানে বড় বড় মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। দূর-দূরান্ত থেকে দলে দলে লোকজন মেলায় আসেন মাছ কিনতে। খালি হাতে ফিরেননি কেউ। সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী মাছ কিনে খুশিমনে বাড়ি ফিরছেন।
মেলা উপলক্ষে আশপাশের গ্রামে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। নাইওর এসেছেন মেয়ে-জামাই। নিমন্ত্রণ করা হয়েছে আত্মীয়স্বজনকেও।
মেলায় প্রায় ৫০ কেজি ওজনের একটি বাঘাইড় মাছের দাম হাকা হয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। মাছটি আনেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের ওরস মিয়া। সিলেটের সুরমা নদীর মাছ এটি। ওই মাছটির দাম উঠেছে ৭৫ হাজার টাকা।
সরজমিন মৎস্যমেলায় গিয়ে দেখা যায় দীর্ঘ এলাকাজুড়ে মাছ নিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। মেলায় উঠেছে বড় বড় মাছ।
শুধু এই বাঘাইড়টিই নয়, মৎস্যমেলায় ঘুরে আরও ১০ থেকে ১২টি বাঘাইড় মাছ দেখা যায়। ২০ থেকে ২৫ কেজি ওজনের এসব মাছের দাম হাকা হয় ৫০ হাজার টাকার উপরে। হাজার টাকার বড় বোয়াল ও ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দামের বেশ কিছু চিতল মাছও উঠে মেলায়।
পইল গ্রামের ডালিয়ার হাটি এলাকার আলী মিয়া নামে এক ব্যবসায়ী ৩০ কেজি ওজনের একটি রুই মাছ নিয়ে আসেন। দাম হাঁকিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা।
আলী মিয়া আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা নদী থেকে শিকার করা মাছটি কিনে আনেন এই মেলায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত একজন ক্রেতা মাছটি ক্রয় করেন ২৭ হাজার টাকায়।
মেলায় আসা হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বহুলা গ্রামের ওমর আলী বলেন, ‘দুই বছর বন্ধ থাকার পর আবারও মেলাটি আয়োজন করায় বড় বড় মাছ দেখতে পেরেছি। এত বড় বড় বাঘাইড় ও বোয়াল মাছ আগে কোথাও দেখিনি।’
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা সহকারী শামীমা শাম্মী জানান, তিনি এই মেলায় গিয়ে বড় বড় মাছ দেখে অনেক আনন্দ পেয়েছেন। তবে, মেলায় নারীদের উপস্থিতি কম এবং অনেক কষ্ট করে মাছ দেখতে হয়েছে।
মেলায় নদীর বাঘাইড়, বোয়াল, আইড়, পাঙ্গাস, চিতল, কাতলা, রুই, সিলভার কার্পসহ হরেক রকমের বড় বড় মাছ উঠে। এ ছাড়া পুটি, চিংড়ি, কৈ, চাপিলা, চান্দা মাছ উঠেছে ব্যাপক হারে। মেলার প্রধান আকর্ষণ মাছ হলেও এতে কৃষি উপকরণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ভোগপণ্য, আখ, শিশুদের খেলনার দোকানও ছিল উল্লেখযোগ্য।
আজ সকাল থেকেই মৎস্যমেলায় হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। বিকেলে এ মৎস্যমেলা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এ মেলা দেখার জন্য শুধু হবিগঞ্জ নয়, সিলেট, মৌলভীবাজর, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ অন্যান্য জেলা থেকেও অনেক লোক আসেন।
মানুষজন মাছের দাম হাকাচ্ছেন, কিনছেন, আবার কেউ কেউ সেলফি তুলতেও ব্যস্ত। শুধু সেলফি তুলেই শেষ নয়। মাছ মেলার ছবি দিয়ে কেউ কেউ আবার ঝড় তুলেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও।
পইল গ্রামের বাসিন্দা সাবেক চেয়ারম্যান সাহেব আলী জানান, মেলায় প্রতি বছরই বাঘাইড় মাছ ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকার উপরে বিক্রি হয়। এ বছর বড় বড় বাঘাইড় ও বোয়াল মাছ উঠেছে মেলায়। একেকটি মাছের ওজন হবে ৩০ থেকে ৪০ কেজি। করোনার কারণে দুই বছর মেলা বন্ধ থাকায় এবার মানুষের উপস্থিতি ছিল বেশি।
পইল মৎস্যমেলার ঐতিহ্য সম্পর্কে পইল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দ মঈনুল হক আরিফ জানান, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বাগ্মী নেতা বিপিন চন্দ্র পালের জন্মভূমি পইল গ্রামে প্রতিবছর এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই মেলাকে ঘিরে এলাকায় উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মেলাকে সামনে রেখে চাষিরা সারা বছর বড় মাছটি সংরক্ষণ করেন। এ ধরনের মৎস্যমেলা জেলার আর কোথাও নেই। এ মেলাকে কেন্দ্র করে বাড়িতে বাড়িতে চলে উৎসব। সামর্থ্য অনুযায়ী এলাকার সবাই মাছ কিনে অতিথি আপ্যায়নও এখানকার একটি সংস্কৃতি।