হাসপাতালে দন্ত চিকিৎসক নেই, খরচ প্রায় ২ কোটি টাকা!
মাদারীপুর সদর হাসপাতালে দন্ত চিকিৎসক নেই দুই বছর ধরে। কিন্তু দন্ত চিকিৎসক না থাকলেও বিপুল অর্থ খরচ হয়েছে। গত অর্থবছরে দন্ত চিকিৎসার উপকরণ (ওষুধ) কেনা হয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ ৩১ হাজার ১৮৪ টাকার। ওষুধসহ মালামাল সরবরাহের কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে। কাগজ-কলমে সরবরাহ থাকলেও বাস্তবে নেই। এতে একদিকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে সরকারি সেবা থেকে অপর দিকে যাচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা।
অভিযোগ রয়েছে, মালামাল সরবরাহের কাজে মাদারীপুর সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রোগীদের অভিযোগের ভিত্তিকে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে।
দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত পাঁচ বছর মাদারীপুর সদর হাসপাতালের মালামাল সরবারহের কাজ পেয়েছে একটি পরিবারের দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, তাদের হাতেই জিম্মি হয়ে পড়েছে মাদারীপুর সদর হাসপাতালের মালামাল সরবারহ কাজ।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন কোটি ৩৮ লাখ ৫৫ হাজার ২১৬ টাকার মালামাল সরবারহ করা হয়। এতে মালামাল সরবরাহের কাজ পায় মেসার্স তাসিন ইন্টারন্যাশনাল ও মিজান ট্রেডিং কোং নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক সিরাজুল আলম খান ও মিজান খান। তাঁরা দুজন আপন ভাই।
সিরাজুল আলম খান মাদারীপুর পৌরসভার কাউন্সিলর এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মালমাল সরবরাহ করা হয় চার কোটি ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ১১৯ টাকার। ওই দুই ভাইয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মালামাল সরবারাহ করে। ২০২০-২১অর্থ বছরেও ওই দুই প্রতিষ্ঠান চার কোটি ৫৬ লাখ ৯০ হাজার ৩৫৭ টাকার মালামাল সরবারাহ করে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মিজান ট্রেডিং কোং ছয় কোটি ৯ লাখ ৭১ হাজার ১২১ টাকার মালামাল সরবরাহ করে।
মাদারীপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে পাঁচ কোটি ৩৭ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করে। সদর হাসপাতালের মালামাল সরবরাহের জন্য ছয়টি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ছয়টি প্যাকেজে ৯৮টি শিডিউল বিক্রি হয়। জমা পড়ে মাত্র ১৩টি শিডিউল।
চলতি অর্থ বছরেও সবাইকে অবাক করে কাজ পেয়ে যায় সেই দুই ভাইয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মিজান ট্রেডিং এবং তাসিন ইন্টারন্যাশনাল। বরাদ্দ করা পাঁচ কোটি ৩৭ লাখ টাকার ‘ক’ গ্রুপের ইডিসিএল বহির্ভূত ওষুধ সামগ্রী ক্রয়ের জন্য ২৫% বরাদ্দ। ‘খ’ গ্রুপের সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ১২%, ‘গ’ গ্রুপে লিলেন সামগ্রী ক্রয় ৫%, ‘ঘ’ গ্রুপে গজ ব্যান্ডেজ ক্রয় ৫%, ‘ঙ’ গ্রুপে কেমিক্যাল ও রিএজেন্ট ক্রয় ৩% এবং ‘চ’ গ্রুপে আসবাবপত্র ক্রয় ৩% বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, গত অর্থবছরের গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৫ টাকা। লিলেন কাপড়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার ৮৪০ টাকা।
সেই হিসাবে প্রতিদিন গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা ও লিলেন কাপরের জন্য খরচ হয়েছে ১৯ হাজার টাকা। অথচ প্রতিদিনই রোগীদের নিজ খরচেই কিনতে হয় এসব সামগ্রী। ১০০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালের জন্য গত অর্থবছরে আইভি ফ্লুইড ও দন্ত চিকিৎসার উপকরণ (ওষুধ) কেনা হয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ ৩১ হাজার ১৮৪ টাকার। অথচ দন্ত চিকিৎসক নেই দুই বছর ধরে। দন্ত চিকিৎসক না থাকলেও বিপুল অর্থ খরচ হয়েছে।
এ ছাড়া অন্যান্য ওষুধ কেনা হয়েছে এক কোটি ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ৯৭৩ টাকার।
মাদারীপুরের পাঁচখোলা গ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী মো. রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের তো জ্বর আর গ্যাস্টিকের ওষুধ ছাড়া সবই কিনে নিতে হয়। হাসপাতাল থেকে বলে সাপ্লাই নাই। শুনি ওষুধ কেনায় কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু তেমন কোনো ওষুধ তো পাই না।
এদিকে সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উভয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাঁদের দাবি, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই তাঁরা মালামাল সরবারহের ঠিকাদারি কাজ করেন। কোনো ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নয় বলেও দাবি করেন তাঁরা। হাসপাতালের ঠিকাদারি কাজ তাঁরা নিয়ম অনুসারেই পেয়ে থাকেন বলে জানান।
মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘আমি যত দূর জানি, মাদারীপুর সদর হাসপাতালে যাঁরা ওষুধ সাপ্লাইয়ের কাজ করেন, তাঁরা দুই-তিন বছর নয়, গত দুই দশক ধরেই ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী সাপ্লাই দেন। তাঁরা হাসপাতালের ঠিকাদারি ব্যবসার একটি শক্ত সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। যার জন্য সব সময়ই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এখানে দ্রুত স্বচ্ছতা আনার দাবি করছি।’
এ ব্যাপারে মাদারীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মুনীর আহমেদ বলেন, মালামাল সরবরাহের কাজে অনিয়ম নেই। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে তদন্ত করা হবে। দন্ত চিকিৎসক না থাকলেও এই খাতে কোটি কোটি টাকা খরচের ব্যাপারে তিনি বলেন, ওই টাকা অন্য খাতে খরচ করা হয়েছে।