হোঁচট খেয়েও নারী উন্নয়নে ইউপি চেয়ারম্যান শম্পার পথচলা
ছোটবেলায় হারিয়েছেন মা-বাবাকে। বিয়ের তিন বছর পর সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন স্বামী। তবুও কোনো প্রতিকূল অবস্থায় দমে যাননি সংগ্রামী নারী কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এম শম্পা মাহমুদ। নানা হোঁচট আর ঘাত-প্রতিঘাতের পরও সমাজ থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি নারী উন্নয়ন ও সমাজ সংস্কারে কাজ করে চলেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, নিজ খরচে এলাকায় গড়ে তুলেছেন প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য স্কুল। পেয়েছেন এর স্বীকৃতিও। কুষ্টিয়া জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছেন শম্পা মাহমুদ।
জন্মের ৯ মাস পর বাবাকে হারিয়েছেন শম্পা, ৯ বছর বয়সে হারিয়েছেন মাকে। এরপর ভাইয়ের সংসারে বেড়ে ওঠা। ১৯৯৭ সালে বিয়ে হয় হাটশ হরিপুর ইউপির জনপ্রিয় চেয়ারম্যান এম মাহমুদ হোসেন সাচ্চুর সঙ্গে। বিয়ের পর তাঁদের ঘরে ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। বিয়ের ঠিক তিন বছর পর ২০০০ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন তাঁর স্বামী। এত ঘাত-প্রতিঘাতেও থেকে থাকেননি শম্পা।
শম্পা মাহমুদের বাবা ও বড় ভাই ছিলেন চেয়ারম্যান। এরপর বিয়ে হয় ইউপি চেয়ারম্যান সাচ্চুর সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর কর্মকাণ্ড খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতেন তিনি। স্বামী মারা যাওয়ার পর একমাত্র সন্তানকে বুকে নিয়ে এলাকার গরিব-দুঃখী, অসহায়, নির্যাতিত ও বিধবা নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। এরপর ২০১৬ সালে এলাকার মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে অংশ নেন শম্পা মাহমুদ এবং সেই নির্বাচনে সাত হাজার ভোটের বিশাল ব্যবধানে তাঁর প্রয়াত স্বামীর বড় ভাইকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।
মূলত চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই স্বামীর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন শম্পা মাহমুদ। সমাজ থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি নারী উন্নয়ন ও সমাজ সংস্কারে আপন মহিমায় কাজ করে চলেছেন তিনি। এ ছাড়া নিজ খরচে এলাকায় স্বামীর নামে গড়ে তুলেছেন প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য স্কুল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র।
নিরন্তর ছুটে চলা এই নারী পেয়েছেন সরকারি স্বীকৃতিও। ২০১৮ সালে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা ও কুষ্টিয়া জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতার পাশাপাশি খুলনা বিভাগীয় পর্যায়ে রানার আপ জয়িতা হিসেবে বেগম রোকেয়া পদক পান তিনি।
শম্পা মাহমুদ জানিয়েছেন, তাঁর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। প্রয়াত স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাকি জীবন সমাজের নির্যাতিত, নিপীরিত ও অসহায় নারীদের কল্যাণে কাজ করে যেতে চান।
২০১৫ সালে ২০ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নিয়ে শম্পা গড়ে তোলেন শহীদ মাহমুদ হোসেন সাচ্চু অটিজম প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লিংকন আহমেদ জানান, বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ২১০ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। তাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য বিদ্যালয়টিতে ১২ জন শিক্ষকসহ মোট ২৫ জন বিনা পারিশ্রমিকে স্বেচ্ছায় সেবাদান করে চলছেন। বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের দাবি এখানকার শিক্ষক-কর্মচারীদের। চেয়ারম্যান শম্পা মাহমুদের এমন মহতি কর্মকাণ্ডে খুশি প্রতিবন্ধী শিশুদের অভিভাবক ও এলাকাবাসী।
উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে কাজ করছেন শম্পা মাহমুদ। জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের প্রোগাম অফিসার মর্জিনা খাতুন বলেন, ‘শম্পা মাহমুদ নিজে একজন অসহায় নারী হয়ে সমাজের অন্যসব নির্যাতিত নারীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করায়, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য আবদান রাখা ক্যাটাগরিতে তাঁকে জয়িতা মনোনীত করা হয়।
সংগ্রামী এই নারী বাকি জীবনও সমাজ সেবায় কাটিয়ে দিক এবং তাঁকে দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশ প্রেমে উজ্জীবিত হবে, ভালো কাজের অনুপ্রেরণা পাবে—এমনটাই প্রত্যাশা কুষ্টিয়াবাসীর।