নাসিরনগরের ঘটনায় আ. লীগের চেয়ারম্যান রিমান্ডে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় আওয়ামী লীগ মনোনীত হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখির পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
আজ রোববার দুপুরে আসামি আঁখিকে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শরাফউদ্দিনের আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাতদিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। আদালত পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নাসিরনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইশতিয়াক আহমেদ জানান, আঁখিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সে দিনের ঘটনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাবে। গত ৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ঢাকার ভাটারা এলাকা থেকে আঁখিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরপর তাঁকে ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরে (ডিএমপি) নিয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
গত ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে ভাঙচুর এবং পরে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় থানায় আটটি পৃথক মামলা হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১০৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটে আতিকুর রহমান আঁখি সহায়তা করেন। তাঁর নির্দেশ ও সহায়তায় সেদিনের তাণ্ডব ঘটে। তিনি ১০ থেকে ১৫টি ট্রাকে করে মানুষ হরিপুর থেকে নাসিরনগর সদরে আনেন। ওই সব ট্রাকের লোকজন পরে হামলা চালায়। তিনি ট্রাকভর্তি মানুষ পাঠিয়ে নাসিরনগরের পরিস্থিতি টালমাটাল করে দেন। বিশেষ নেতাদের ইন্ধনে স্থানীয় সংসদ সদস্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হককে কুপোকাত করতেই হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে ভাঙচুর চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, বিশেষ নেতাদের অনুকম্পায় আতিকুর রহমান আঁখি এত দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান করছিলেন। এরপর পুলিশ তদন্ত করে হামলার ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়। গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করলে আঁখি গা-ঢাকা দেন। তাঁর অবস্থান জানতে এর আগে ব্যক্তিগত সহকারী ও ইউপি সচিবকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে।
গত ২৮ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের বাসিন্দা রসরাজ দাস নামের এক যুবকের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক আইডি থেকে পবিত্র কাবাঘরের ছবি সম্পাদনা করে পোস্ট করা হয়। এ নিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠার পর স্থানীয় লোকজন তাঁকে পুলিশে দেয়।
এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে পরের দিন ২৯ অক্টোবর দিনভর নাসিরনগর সদর উত্তাল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় পরের দিন ৩০ অক্টোবর উপজেলা সদরের কলেজ মোড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। সমাবেশ চলাকালে সদরের একাধিক মন্দির ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
এ ঘটনার পর ৪ নভেম্বর উপজেলায় হিন্দুদের পাঁচটি ঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ৫ নভেম্বর নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন কুমার দেবের গোয়ালঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এরপর ১৬ নভেম্বর তাঁর বাড়ির আঙিনায় রাখা পাটখড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
নাসিরনগরে মন্দির ও বাড়িঘর ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন এবং নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদেরকে প্রত্যাহার করা হয়। সহিংসতার ঘটনায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় স্থানীয় তিন নেতাকে সাময়িক বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ। তাঁরা হলেন নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক আহম্মেদ, চাপড়তলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরুজ আলী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহপ্রচার সম্পাদক আবুল হাশেম। এ ছাড়া গত ২৭ ডিসেম্বর নাসিরনগরের হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলার ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল আহাদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেওয়া হয়।
এদিকে গত ২৮ নভেম্বর জেলা পুলিশের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে রসরাজের ব্যবহৃত মুঠোফোন থেকে ধর্ম অবমাননাকর সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়নি বলে উল্লেখ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ফরেনসিক বিভাগ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইনও এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন।