সম্পত্তির জন্য বাবুলকে জড়িয়ে পরকীয়ার গল্প!
‘সড়ক দুর্ঘটনায়’ নিহত পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আকরাম হোসেনের স্ত্রী আবারও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, তাঁর ননদরা (আকরামের পাঁচ বোন) সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের সঙ্গে তাঁর পরকীয়ার মিথ্যা গল্প তৈরি করছেন। আকরামের কেনা ঢাকার ফ্ল্যাট ও ঝিনাইদহের বাড়ি থেকে একমাত্র মেয়ে ও তাঁকে বঞ্চিত করতেই ননদরা পরকীয়ার নাটক সাজিয়ে একধরনের অপকৌশলে মেতে উঠেছেন।
আজ সোমবার দুপুরে মাগুরা প্রেসক্লাবে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এ সময় তাঁর বাবাও উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে সংবাদ সম্মেলন করেন এসআই আকরামের স্ত্রী। ওই দিন তাঁর একমাত্র মেয়ে (৮) ও মা ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ওই সংবাদ সম্মেলনে আকরামের স্ত্রী দাবি করেন, ‘এসপি বাবুল আক্তারের সঙ্গে জড়িয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তাঁর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং নেই। বাবুল আক্তারের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি এবং তাঁর সঙ্গে কখনো কোনোভাবে কথা হয়নি। যা আমার ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বর অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে।’
এ নিয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি এনটিভি অনলাইনে ‘কাঁদতে কাঁদতে নারী বললেন, এসপি বাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এসআই আকরামের পাঁচ বোন ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা অভিযোগ করেন, তাঁদের ভাই এসআই আকরাম হোসেনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর এ পরিকল্পনার সঙ্গে বাবুল আক্তার ও তাঁদের ভাইয়ের স্ত্রী জড়িত ছিলেন। বিয়ের আগে থেকেই তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের পরও সেই সম্পর্ক চলে।
স্বামীর মূল্যবান সম্পদই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে!
সংবাদ সম্মেলনে এসআই আকরামের স্ত্রী লিখিত বক্তব্যে বলেন, তাঁর স্বামী এসআই আকরাম হোসেনের পাঁচ বোন। আকরাম পুলিশের হয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সাউথ সুদানে চাকরি করেছেন। শান্তিরক্ষা মিশন থেকে উপার্জিত অর্থে আকরাম হোসেন নিজ নামে ঢাকার মগবাজারে একটি ফ্ল্যাট কেনেন। ফ্ল্যাটটি কেনার পর ননদরা জানতে পেরে তা বিক্রি করে পাঁচ বোনকে টাকা ভাগ করে দিতে চাপ প্রয়োগ করেন। এ সময় তাঁদের অত্যাচারে আকরাম একমাত্র মেয়ের নামে ফ্লাটটি দানপত্র মূলে রেজিস্ট্রি করে দেন। এ ছাড়া ঝিনাইদহ শহরে ৩০ শতক জমির ওপর আকরামের দ্বিতল বাড়ি রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো। এই মূল্যবান সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্যই প্রথমে বলেছে, তাঁর ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর প্রেম ছিল। ওই ভাইয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তিনি নাকি তাঁর স্বামী আকরামকে হত্যা করেছেন। ওই ঘটনার দুই বছর পর এখন বলছে বাবুল আক্তারের সঙ্গে তাঁর পরকীয়া রয়েছে। পাঁচ বোনের স্বার্থ হাসিল না হওয়া পর্যন্ত তারা একেকজনকে জড়িয়ে মনগড়া কল্পকাহিনী তৈরি করবে।
এসআই আকরামের স্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যেক নারীই চায় তাঁর স্বামীর ভিটেমাটিতে পড়ে থাকতে। কিন্তু আমি তা পারি নাই। স্বামীর এ মূল্যবান সম্পদই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার এতিম একমাত্র মেয়ে ও আমার জীবনে।’
পাঁচ বোন যা বলেছিলেন
১৭ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবে এসআই আকরামের পাঁচ বোন সংবাদ সম্মেলন করেন। লিখিত বক্তব্যে এক বোন জান্নাত আরা পারভীন রিনি বলেছিলেন, বিয়ের আগে থেকেই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার ও তাঁদের ভাইয়ের স্ত্রীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের পরও সেই সম্পর্ক চলতে থাকে। এ নিয়ে ভাই-ভাবির মধ্যে ঝগড়া হতো। ঘটনার কয়েক দিন আগে ভাবি ঢাকার বাসা ছেড়ে ঝিনাইদহের একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। ঘটনার দিন ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে যমুনা সেতু হয়ে এসআই আকরাম মোটরসাইসাইকেলে চড়ে ঝিনাইদহে আসার পথে বড়দা নামক স্থানে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। তাঁর মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে ঝিনাইদহে ও পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহত হওয়ার ১৭ দিন পর ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। এ ঘটনায় সেই সময় শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাশেম খান মামলা নেননি। বরং সড়ক দুর্ঘটনায় আকরাম নিহত হয়েছেন বলে তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী যে অপমৃত্যুর মামলা করেন তা গ্রহণ করা হয়।
এরপর ২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি ঝিনাইদহের আদালতে একটি পিটিশন মামলা দায়ের করেন এসআই আকরামের বোন জান্নাত আরা পারভীন রিনি।
মৃত্যুর পর ফুপাতো ভাই, দুই বছর পর বাবুল!
ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসআই আকরামের স্ত্রী সোমবার বলেন, ‘২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ঝিনাইদহের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৃতীয় আদালতে ননদ জান্নাত আরা পারভীন রিনি বাদী হয়ে আমার এক ফুপাতো ভাইকে ১ নম্বর আসামি, আমি, আমার বাবা ও মাকে আসামি করে মোট চারজনের বিরুদ্ধে কুপিয়ে ও স্যুপে বিষ মিশিয়ে হত্যার অভিযোগে মামলা (নম্বর : শৈলকুপা পি ৮/১৫) দায়ের করেন। ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরকীয়ার কল্পকাহিনী মামলায় উল্লেখ করা হয়।’
‘ওই সময়ের পর থেকে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে কখনো বাবুল আক্তারের কোনো নামগন্ধ ননদরা কোথাও বলেননি। অথচ এখন ফুপাতো ভাইকে বাদ দিয়ে বর্তমান সময়ের আলোচিত সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের সঙ্গে আমাকে নিয়ে নতুন কাহিনী সৃষ্টি করছেন কুচক্রী ননদরা।’
আকরামের চিকিৎসার টাকায়ও ভাগ বসান বোন!
আকরামের স্ত্রী অভিযোগ করেন, ‘আমার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ঢাকা সিটি এসবি (পুলিশ) থেকে এক লাখ টাকা চিকিৎসা সহায়তা বাবদ আমার হাতে প্রদান করে। তখনই আমার ননদ জান্নাত আরা পারভীন রিনি আমাকে চাপ প্রয়োগ করে সম্পূর্ণ টাকা বোনজামাই আবদুর রশিদকে দিয়ে দিতে বলেন। রিনির চাপ প্রয়োগে আমি স্বামীর চিকিৎসার কথা ভেবে ওই সময়ে আবদুর রশিদের হাতে ৫০ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হই। এ বিষয়টি ঢাকার পুলিশের তৎকালীন এস এস অ্যাডমিন তৌফিক সাহেব ও ফারাজী সাহেব অবগত আছেন।’
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, ‘স্বামী আকরাম হোসেন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তাঁকে ঝিনাইদহে এনে দাফন করা হয়। দাফনের পর পরই আমার ননদরা স্বামীর নামীয় সম্পত্তি ও ঢাকার ফ্ল্যাট লিখে নেওয়ার জন্য আমার ওপর অত্যাচার করে। একই সময়ে আমার কলেজশিক্ষক চাচা ও তাঁর ছেলেকে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। এ ছাড়া আমার দুই মামাকে ধরে নিয়ে আটকে রাখে। এ অবস্থায় আমি শিশু কন্যাসহ পালিয়ে যেতে বাধ্য হই এবং আত্মগোপন করি।’
আরো তদন্ত হলেও আপত্তি নেই
আকরামের স্ত্রী বলেন, পরকীয়া প্রেমিক দিয়ে কুপিয়ে ও স্যুপের মধ্যে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা মামলায় স্বামী আকরাম হোসেনের লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগে এবং মহাখালীর সিআইডিতে। সেখানে আকরামের শরীরের বিভিন্ন অংশের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কোনো বিষের আলামত পাওয়া যায়নি এবং অধিকতর তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সাজ্জাদ হোসেন। স্বামীর মৃত্যু নিয়ে আরো কোনো উচ্চপর্যায়ের তদন্ত হলে তাতে কোনো আপত্তি নেই বলে জানান আকরামের স্ত্রী।
৪ বছর বয়সে প্রেম!
আকরামের স্ত্রী বলেন, ‘খুলনায় আমার বাবা যখন চাকরি করতেন তখন বাবুলের বাবার বাসার পাশে বাস করতেন বলে তাঁর ননদ যে অভিযোগ করেছেন তা সত্য নয়। খুলনায় যখন আমার বাবা ১৯৯০ সালে চাকরি করতেন তখন বয়স মাত্র চার বছর। ওই বয়সে কারো সঙ্গে প্রেম করা সম্পূর্ণ অবান্তর ও অবাস্তব কাহিনী মাত্র। এটা কতটা সম্ভব তা বিবেকবান মানুষের কাছে আমার প্রশ্ন। অথচ ননদ রিনি ওই সময় থেকে বাবুল আক্তারের সঙ্গে প্রেম ছিল বলে মিথ্যাচারে নেমেছেন।’
সংবাদ সম্মেলনে আকরামের স্ত্রী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দাবি করেন, ‘বাবুল আক্তারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় নেই। দেখা-সাক্ষাৎও হয়নি। আমার ননদরা আমার স্বামীর ধন-সম্পদের লোভে আমাকে জড়িয়ে বিভিন্ন সময়ে পরকীয়ার নতুন নতুন কাহিনী প্রচার করছে। আমাকে হয়রানি করছে। মামলা, হামলা ও শিশুকন্যাসহ আমাকে জীবননাশের হুমকি দিচ্ছে। ফলে আমি তাদের ভয়ে আত্মগোপনে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। আমি আমার এতিম কন্যার ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করি।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত আকরামের শ্বশুর বলেন, ‘মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনে ২০০৯ সাল থেকে কর্মরত রয়েছি। আমার মেয়ের নিরাপত্তার জন্য প্রায়ই তাঁকে আমার কাছে এনে রাখতে হয়। তাই বাবুল আক্তারের মাগুরার বাড়িতে আমার মেয়ের থাকার কোনো দরকার হয় না।’
এসআই আকরামের স্ত্রীর অভিযোগের ব্যাপারে জানতে জান্নাত আরা পারভীন রিনির ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।