একনজরে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’
২৩ মার্চ দিবাগত রাত ৩টা : সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ি এলাকায় ‘আতিয়া মহল’ বাড়িটি জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাড়ির ফটকে তালা লাগিয়ে দেয়।
বাড়িটির মালিক উস্তার আলী। বাড়িটিতে একটি চারতলা ও একটি পাঁচতলা ভবন রয়েছে। দুটি ভবনের ২৯টি ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়ারা থাকেন। ওই বাড়ির নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে কাওসার আহমেদ ও মর্জিনা বেগম নামে এক দম্পতি রয়েছেন বলে জানায় পুলিশ।
ভোর রাত : বাড়ির ভেতর থেকে জানালা খুলে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দেয়, এরপরই বিকট শব্দে বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এর কিছুটা পরে সেখান থেকে একটি গ্রেনেডও ছোড়া হয়।
২৪ মার্চ সকাল : শিববাড়ি এলাকায় মানুষ ঘুম থেকেই জেগে দেখেন অবরুদ্ধ অবস্থা। ‘আতিয়া মহলে’ যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। চারতলা ভবন থেকে ১৭টি পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করে স্থানীয় একটি স্কুলে নিয়ে রাখা হয়। পরে সন্ধ্যায় তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি গিয়ে থাকতে বলা হয়।
সকাল ৯টা : সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। শিববাড়ি এলাকায় গ্যাস ও পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ‘আতিয়া মহলের’ আশপাশের কয়েকটি ভবন থেকেও বেশকিছু লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
সকাল ১০টা : অভিযানের নেতৃত্বদানকারী সিলেটের পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া জানান, ওই ভবনে অভিযানের জন্য ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী সোয়াট ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ঘটনাস্থলে যাচ্ছে।
দুপুর সাড়ে ১২টা : পুলিশের পক্ষ থেকে হ্যান্ডমাইকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু জঙ্গিরা কোনো সাড়া দেয়নি।
দুপুর দেড়টা : পুলিশের পক্ষ থেকে আবারও জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। এবার ঘরের ভেতর থেকে এক নারী জঙ্গি বলেন, ‘আপনারা শয়তানের পথে আছেন, আমরা আল্লার পথে।’ এর কিছুক্ষণ পরেই আরেক পুরুষ বলেন, ‘দেরি করছো কেন, সময় কম। তাড়াতাড়ি সোয়াট পাঠাও।’
বিকেল ৪টা : ঢাকা থেকে সোয়াট সদস্যরা সিলেটে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছার পরই তারা ‘জঙ্গি আস্তানা’ ও আশপাশ পর্যবেক্ষণ করেন। পরে সোয়াট সদস্যরা সেখানে কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলে ভবনটি ঘিরে ফেলেন।
সন্ধ্যা ৬টা : সারা দিন শিববাড়ী এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকলেও সন্ধ্যায় এই এলাকায় বিদ্যুৎ দেওয়া হয়। পাশাপাশি জেনারেটরের মাধ্যমে ‘আতিয়া মহল’ আলোকিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তৈরি রাখা হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের যানবাহন ও অ্যাম্বুলেন্স। অভিযানের প্রস্তুতি শুরুর কথা জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অবশ্য সন্ধ্যার কিছু আগে ওই এলাকা থেকে লুঙ্গি পরা এক যুবককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
রাত ৮টা : অভিযানে যোগ দিতে সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো ব্যাটালিয়নের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এরপর রাতে সেখানে পৌঁছান কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। রাতভর পুরো এলাকাই কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
২৫ মার্চ সকাল : সকালে অভিযান শুরুর আগে সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সংযোগ। কর্মরত সাংবাদিকদের ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সকাল সাড়ে ৮টা : সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামের এই অভিযানে নেতৃত্বে দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল কমান্ডিং অফিসার (জিওসি) আনোয়ারুল মোমেন। সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো দল এ অভিযান পরিচালনা করছে। তাদের সহযোগিতা করছেন পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও সোয়াট সদস্যরা।
সকাল সাড়ে ৯টা : বৃষ্টির মধ্যেই ‘আতিয়া মহল’ নামের পাঁচতলা ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে আটকে পড়া ৪০ জনকে উদ্ধার করেছেন সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো দলের সদস্যরা। তাঁরা ভবনে প্রবেশ করে পাঁচতলা ভবনটির চারতলায় বিশেষভাবে তৈরি করা মই দিয়ে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পাঠাচ্ছেন। এরপরও দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আরো কয়েকজনকে উদ্ধার করা হয়।
সকাল সাড়ে ১০টা : ‘আতিয়া মহল’ এলাকায় পরপর দুটি গুলির শব্দ শুনতে পান সাংবাদিকরা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বৃষ্টি থেমে যায়।
দুপুর সোয়া ১টা : সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, ভবন থেকে বাসিন্দাদের বের করে আনার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এরপর দুপুর ২টা পর্যন্ত থেমে থেমে অন্তত দুবার গুলির শব্দ শুনতে পান সাংবাদিকরা।
দুপুর ২টা : শিববাড়ি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বেষ্টনীর ভেতর একটি অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করে। ঘটনাস্থল থেকে প্রথমে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়। পরে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ আসতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই এই শব্দ আসে।
দুপুর আড়াইটা : একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তিনজন সেনাসদস্যকে নিয়ে যেতে দেখেছেন সাংবাদিকরা। এর কিছু পর পৌনে ৩টার দিকে এই এলাকার শিবুল মালাকার নামে এক যুবককে আহত অবস্থায় সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়।
দুপুর সাড়ে ৩টা : প্রায় দেড় ঘণ্টা থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যায়। এরপর আর কোনো শব্দ আসেনি।
বিকেল ৫টা : আবার গুলির শব্দ।
সন্ধ্যা ৬টা : অভিযান সম্পর্কে সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, সেনাবাহিনী ‘আতিয়া মহল’ থেকে ৭৮ জনকে উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে ৩০ জন পুরুষ, ২১ জন নারী ও ২৭ জন শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযান কখন শেষ হবে, এ ব্যাপারে কোনো ধারণা দেননি তিনি।
সন্ধ্যা ৭টা : ‘আতিয়া মহল’ থেকে আধা কিলোমিটার দূরে একটি স্থানে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে একজন নিহত এবং অন্তত ১৫ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন। তাঁদের সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রাত ৮টা : খুব কাছাকাছি স্থানে আরেকটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। দুটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতদের দেখতে হাসপাতালে আসেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা।
রাত সাড়ে ৯টা : মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার জেদান আল মুসা জানান, দুটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় মোট তিনজন মারা গেছেন। এঁরা হলেন পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মোহাম্মদ কায়সার এবং স্থানীয় যুবক ওয়াহিদুল ইসলাম অপু (২৪)। অন্য এক ত্রিশোর্ধ্ব যুবকের পরিচয় জানা যায়নি। আহতদের মধ্যে তিনজন পুলিশ ও দুজন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) দুই সদস্য রয়েছে।