‘অন্য দেশের রাজনীতিবিদ হলে সম্মান রক্ষায় বাড়ি ছাড়তেন’
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রায়ের আলোকে মওদুদ আহমদকে বাড়ি অবশ্যই ছাড়তে হবে। বাড়িটা বর্তমানে নিয়ে নেওয়া সরকারের দায়িত্ব।
আজ রোববার রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন।
তবে এর আগেই রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘আমি বাড়ি ছাড়ব না, বাড়ি ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ, বাড়ির মালিক সরকার নয়।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘অন্য যেকোনো দেশে হলে রাজনীতিবিদ এ প্রশ্ন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সম্মান রক্ষার্থে বাড়ি ছেড়ে দিতেন।’
মাহবুবে আলম আরো বলেন, ‘মওদুদ আহমদ তাঁর ভাইয়ের নামে বাড়িটির মূল মালিকের সঙ্গে যে চুক্তি দেখিয়েছিলেন, সেটার মামলা আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। রায়ে বলা হয়েছিল, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি এবং চুক্তিটা জাল জালিয়াতির মধ্যে হয়েছে।’
‘সেটাই মওদুদ আহমদ বলতে চান তাঁর ভাইয়ের আইনজীবী হিসেবে, মহসিন দরবার নামে এক লোকের সঙ্গে বাড়িটি নিয়ে চুক্তি হয়েছিল, যিনি বাংলাদেশে ছিলেন। আমরা বলেছি, মালিক ইনজে প্লাজ অস্ট্রিয়ান নাগরিক। তিনি ১৯৮৫ সালের ৩০ মার্চ মারা যান। কথিত মহসিন দরবার ইনজের পক্ষে চুক্তি দেখিয়েছিল, যেটা হয়েছে একই সালের আগস্ট মাসে।’
‘তার মানে মালিক মারা যাওয়ার পাঁচ মাস পরে। আর বাড়ি পাওয়ার জন্য ওনারা মামলা করেছিলেন ১৯৯৩ সালে। বিচারিক আদালত এবং আপিল বিভাগ রাইটলি বলেছেন, তাদের নামে নামজারি হবে না।’
রিভিউর আদেশের বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেন, ‘ওনাদের অনুরোধে আদালত বলছে, বিচারে ভুল হয়নি। তবে বিষয়টি দেখব। এখন অবৈধভাবে একজন লোক থাকবে আর সরকার সেটা মেনে নেবে, তা হতে পারে না।’
অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, ‘এ মামলায় মওদুদ একটি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেখিয়েছিলেন, যেখানে তাঁর ভাই তাঁকে বাড়িটি দেখাশোনা করতে নিয়োগ দিয়েছেন। সুতরাং যেখানে তাঁর ভাইয়েরও কোনো টাইটেল নাই, অধিকার নাই তাঁর মামলা ডিসমিস হয়ে গেছে উচ্চ আদালতে। এ বাড়িতে যে তিনি থাকবেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে, এ কথা বলা তো আমি মনে করি এর চেয়ে বড় ধৃষ্টতা আর হতে পারে না।’
মূল মালিকের সঙ্গে মওদুদ আহমদের বোঝাপড়ার বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেন, ‘মালিক তো বিদেশি। স্বাধীনতার পরে আসেননি কোনো সময়েই। এখানে ছিলেনই না। ওনার এ সমস্ত কথা দুঃখজনক। মূল মালিকের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মামলায় হেরে যেয়ে এ কথা বলাও দুঃখজনক।’
রিভিউ খারিজের পর বাদি ছাড়তে হবে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই ছাড়তে হবে।’
তার আগে রায়র পর মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আমি বিরোধী দলে আছি বলে আজকে এ মামলায় সাত বছর পরে আপিল করেছে সরকার।’
বাড়ি ছাড়তে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে তো সরকারকে স্বত্ব দেওয়া হয়নি। অধিকার দেওয়া হয়নি। আমরা মূল মালিকের সঙ্গে বোঝাপড়া করব। ওনার ছেলে করিম সুলায়মান আছে। আর আদালতও কিছু পর্যবেক্ষণ দেবেন।’
যদি সরকার বাড়ি ছাড়তে বলে তখন কী করবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মওদুদ বলেন, ‘দেশে কি আইন নাই? আমি আইনের আশ্রয় নেব। আদালতের আশ্রয় নেব। বাড়ি ছাড়ব না।’
এর আগে সকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের গুলশানের ২ নম্বর সেকশনের ১৫৯ নম্বর বাড়িটির মালিকানা বিষয়ে করা রিভিউ খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ রিভিউ শুনানি শেষে এ রায় ঘোষণা করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘বাড়ির মালিক অস্ট্রীয় নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজ। তাঁর সঙ্গেই বোঝাপড়া হবে। এটা আমার ও বাড়ির মালিকের বিষয়। সরকারের কোনো বিষয় নয়।’
মওদুদ আহমদ আরো বলেন, ‘বাড়ির মালিক যে সরকার, আদালত তা উল্লেখ করেনি এবং সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি।’
গত ৩১ মে শুনানি শেষে ৪ জুন রায়ের দিন নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ। গত বছর ২ আগস্ট মওদুদ আহমদের ভাই মনজুর আহমদের নামে ওই বাড়ির নামজারির নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজউকের আপিল গ্রহণ করেন আপিল বিভাগ।
গত ৩০ আগস্ট এ মামলার ৮০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। সেই রায়ের বিরুদ্ধে পরে রিভিউ করেন মওদুদ।
এক আবেদনের শুনানি নিয়ে ২০১০ সালের ১২ আগস্ট ওই বাড়ি মনজুর আহমদের নামে মিউটেশন করার জন্য হাইকোর্ট রায় দেন। রাজউক এ রায়ের বিরুদ্ধে ‘লিভ টু আপিল’ দায়ের করে ২০১১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ আপিল বিভাগ রাজউককে আপিলের অনুমতি দেন। এরপর চলতি বছর এ মামলার শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।
২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাড়িটি নিয়ে দুদকের উপপরিচালক হারুনুর রশীদ রাজধানীর গুলশান থানায় মওদুদ আহমদ ও তাঁর ভাই মনজুর আহমদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
২০১৪ সালের ১৪ জুন এ মামলায় অভিযোগ আমলে নেন বিচারিক আদালত। এর বিরুদ্ধে তাঁদের আবেদন গত বছরের ২৩ জুন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।
পরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ‘লিভ টু আপিল’ করেন মওদুদ আহমদ। এ আবেদনের শুনানি শেষ হওয়ার পর রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখেন আপিল বিভাগ। মঙ্গলবার দুটি বিষয়ে রায় দেন আপিল বিভাগ।
দুদকের করা মামলার অভিযোগে বলা হয়, বাড়িটির প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির (রাজউক) কাছ থেকে এক বিঘা ১৩ কাঠার এ বাড়ির মালিকানা পান এহসান। ১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্রে এহসানের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী অস্ট্রিয় নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামও অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করেন এহসান। তাঁরা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়।
এর পর ১৯৭৩ সালের ২ আগস্ট মওদুদ তাঁর ইংল্যান্ডপ্রবাসী ভাই মনজুরের নামে একটি ভুয়া আমমোক্তারনামা তৈরি করে বাড়িটি সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ নেন বলে মামলায় অভিযোগ করে দুদক।