সাক্ষাৎকার
‘আমরা ই-পাসপোর্ট দিতে চাচ্ছি’
পাসপোর্ট করা, বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ, পাসপোর্টের কার্যালয়ে যাওয়া এসব নিয়ে মানুষের ভোগান্তি ও অভিযোগের অন্ত ছিল না। দালালদের দৌরাত্ম্য, হয়রানি যেন শেষই হওয়ার নয়। তবে এখন অনেক ঠিক হয়ে এসেছে। আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো হয়েছে আধুনিক। কমেছে হয়রানি ও দালালদের দৌড়ঝাঁপ।
এ ছাড়া পাসপোর্ট করা ও গ্রহণ করার পদ্ধতি হয়েছে ডিজিটাল। এসেছে অনেক পরিবর্তন। সামনে আরো পরিবর্তন আসবে।
এসব বিষয় নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন, বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মো. মাসুদ রেজওয়ান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জনি রায়হান।
এনটিভি অনলাইন : পাসপোর্ট অফিসগুলোর ব্যাপারে একটা অভিযোগ সব সময় শোনা যায়। দালালদের দৌরাত্ম্য…
মাসুদ রেজওয়ান : আমরা দালাল অনেকাংশে নির্মূল করেছি। এ জন্য কয়েক ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। এর ধারাবাহিকতায় আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। আমি এতটুকু বুঝি, আমাদের লোকজন (পাসপোর্ট অধিদপ্তর) যদি দালালদের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকে তবে দালালদের কাজ করাটা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের লোকজন অনেকটা সচেতন হয়ে গেছে। তারা তাদের কাজটা সম্পর্কে সচেতন হয়ে গেছে। তারা তাদের কাজটা সম্পর্কে বুঝেছে যে কাজটা শুধুই সেবা।
এনটিভি অনলাইন : কর্মকর্তাদের ভেতরে কীভাবে এবং কী পরিবর্তন এসেছে?
মাসুদ রেজওয়ান : জনগণের সেবা আমরা যেভাবে দিচ্ছি সেটা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। কেউ এই সরাসরি সেবাটা দেয় না। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। তাদের মনের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে কারণ আমরা গত বছর ভালো কাজের জন্য তাদের পুরস্কৃত করেছি। যারা ভালো কাজ করছে তাদেরকে বিদেশে পাঠাচ্ছি। গত বছর প্রায় ৪৮ জনকে আমরা বিদেশে পাঠিয়েছি। আর এ বছর প্রায় ২৫ জনকে বিদেশে পাঠাব বলে নির্বাচিত করেছি।
এনটিভি অনলাইন : দালাল নির্মূল করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য গ্রহণ করেন কি?
মাসুদ রেজওয়ান : দালাল নির্মূল করতে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক রকম সাহায্য নিচ্ছি। বিশেষ করে র্যাব, পুলিশের সাহায্য করছে। যারা বাইরে থেকে এসে পাসপোর্ট অফিসে দালালি করে, তাদের ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দালালদের ধরতে ঢাকাসহ বাইরের জেলাগুলোতেও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। এরপরও একেবারে যে দালাল নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে, তা নয়। আমাদের দেশে এত মানুষ। এদের মধ্যে অনেক মানুষ পাসপোর্ট করতে আসে কিন্তু তারা ফরম পূরণ করতে পারে না। তখন কেউ তাদের ফরমটি পূরণ করে দিয়ে হয়তো ১০০ টাকা নেয়। এটিকে দালালিও বলা যায়, আবার কাজের পারিশ্রমিক হিসেবেও ধরা যায়। এ ছাড়া একটা ছোট শিশু; সে হাতে একটা পিন মেশিন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফরমে পিন মেরে দিয়ে হয়তো ২০ টাকা চেয়ে নেয়। এখন তার এটা যদি আপনি দালালি মনে না করে অন্যভাবে ভাবেন বা দালালি শব্দটা এদের থেকে বাদ দেন তবে বলা যায় অনেক অংশেই কমে গেছে।
এনটিভি অনলাইন : এ তো গেল আপনার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথা। আবেদনকারীরা কি দালালদের দিয়ে কাজ করাতে চায়?
মাসুদ রেজওয়ান : আমাদের দেশের অনেক মানুষ আছে যারা বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ই ভাবে দালালতে ঘুষ দিয়ে কাজ করাবে। আমাদের নিজেদের এই রকম মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আর আমাদের দেশে অশিক্ষিত লোক অনেক, যারা পাসপোর্ট করতে চায় এবং বিভিন্ন দেশে যেতে চায়। অদক্ষ জনশক্তি হিসেবে যেতে চায়, তাদের জন্য লিখে পাসপোর্টের আবেদন করা অনেক কঠিন। পাসপোর্টের জন্য বাংলা ছাড়াও ইংরেজিতে ফরম পূরণ করতে হয়। সে কারণে তারা অনেকের সাহায্য নেয়।
এনটিভি অনলাইন : পুলিশের যাচাই ও বাছাই সংক্রান্ত প্রতিবেদন বা ভেরিফিকেশন রিপোর্ট নিয়ে অনেক রকম ঝামেলা হয় বলে অভিযোগ আছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
মাসুদ রেজওয়ান : পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট একেবারে তুলে দেওয়া যাবে না। কারণ আমাদের দেশে অনেক রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। তাদের কোনো ঠিকানা নেই, সুতরাং তাঁরা যদি বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বাইরে গিয়ে কোনো অপরাধ করে, তার দায়ভার দেশের। সে কারণে তাদের পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট রাখতে হবে।
এ ছাড়া যারা স্মার্ট আইডি কার্ড পাচ্ছে, তাতে যদি সব তথ্য সঠিক থাকে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি অনুমতি দেয় তবে এবং আমাদের পাসপোর্ট অফিসের যদি কোনো অভিযোগ না থাকে তবে সে ক্ষেত্রে আমরা হয়তো পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া তাদের পাসপোর্ট দিতে পারব।
এনটিভি অনলাইন : আর কয়েক মাস পরই হজ। এখন রমজান মাস। এ সময়টায় চাপ বাড়ে। এ সময়টা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
মাসুদ রেজওয়ান : পাসপোর্ট করা ও সংগ্রহ এসবের চাপ সারা বছরই থাকে। তবে রমজানের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে এখন লোকজন বেশি উমরা পালন করতে যাচ্ছে।
উমরা ও হজের জন্য আলাদা করে লাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর হজযাত্রীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
আর একটি কাউন্টার করা হয়েছে সেখানে অসুস্থ রোগী, বয়স্ক মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধারা সেবা পাবেন। এটি এর আগে ছিল না। এক বছর আগে এটা চালু করা হয়েছে। তাদের বসার জন্য আলাদা একটা রুম করা আছে। সে রুমে তারা এসে বসতে পারে, আর এ জন্য যারা বয়স্ক লোক তাদের অনেক সুবিধা হয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : অনলাইনে যারা ফরম পূরণ করে, তাদের জন্য কি আলাদা কোনো ব্যবস্থা আছে?
মাসুদ রেজওয়ান : কেউ যদি অনলাইনে ফরম পূরণ করে আসে, তবে তার জন্য আলাদা লাইনের ব্যবস্থা করা আছে। কারণ যে অনলাইনে ফরম পূরণ করে আসে তার সব তথ্য আমাদের কাছে থাকে। আর তার কাজটা খুব তাড়াতাড়ি করা যায়।
এনটিভি অনলাইন : অনেকে হাতে লেখা ফরম পূরণ করে নিয়ে যায়, সে কারণে তাদের লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। ফলে তাদের অনেক ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়, তাদের জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা আছে কি?
মাসুদ রেজওয়ান : যারা হাতে লেখা ফরম নিয়ে আসে, তাদের জন্য জেনারেল লাইন রয়েছে। তবে তাদের এত লম্বা লাইন এখন হয় না। আর যারা এখন আসছে, তাদের বেশির ভাগই রি-ইস্যু পাসপোর্ট।
এনটিভি অনলাইন : রি-ইস্যু পাসপোর্ট করতে কী কী প্রয়োজন এবং কতদিন সময় লাগে?
মাসুদ রেজওয়ান : রি-ইস্যু পাসপোর্ট আবেদনকারীর সকল তথ্য আমাদের কাছে থাকে। এ কারণে তাদের তেমন কিছুই করতে হয় না। কেবল একটা স্বাক্ষর লাগে। একটা স্বাক্ষর করে একটা ফরম নিয়ে আসবে। এরপর ব্যাংকে যে টাকা জমা দিয়েছে তার স্লিপটা ফরমের সঙ্গে সংযুক্ত করে জমা দেবে। তার ছবি তোলার বা আর অন্য কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই।
এনটিভি অনলাইন : পাসপোর্ট এবং ইমিগ্রেশন নিয়ে আপনার নতুন কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
মাসুদ রেজওয়ান : আমরা যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্টের (এমআরপি) পরিবর্তে ই-পাসপোর্ট দিতে চাচ্ছি। আর ই-পাসপোর্ট করার প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ই-পাসপোর্টে ১০ আঙুলের ছাপ এবং চোখের মণির ছবি নেওয়া হবে। পাসপোর্টের চিপে চোখের মণির ছবি দেওয়া থাকবে। আমরা বিমানবন্দরগুলোতে ই-গেট স্থাপনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছি।
এই ই-গেটস যদি স্থাপন করি, তাহলে আপনার পাসপোর্টটা যখন ওই ই-গেটের মনিটরে রাখবেন, তখন ই-গেটের মনিটরে ই-পাসপোর্টের চিপ থেকে চোখের মণিটা রিড করবে। আপনি যে সেই স্পটে দাঁড়িয়ে আছেন, তখন সেটা ক্যামেরায় রিড করবে। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আপনার চোখের কর্নিয়ার যে ইমপ্রেশন আর পাসপোর্ট করার সময় আপনার চোখের কর্নিয়ার যে ইমপ্রেশনটা দিয়েছিলেন, তা যদি মিলে যায় তাহলে এই গেটের দরজা খুলবে। না হলে খুলবে না। না খুললে বোঝা যাবে পাসপোর্টের কোনো সমস্যা আছে।
এনটিভি অনলাইন : আঘাতের কারণে বা অন্য কারণে চোখের কোনো পরিবর্তন যদি চলে আসে তবে?
মাসুদ রেজওয়ান : চোখের কর্নিয়ার কোন পরিবর্তন হয় না।আর পাসপোর্ট করার সময় চোখের কর্নিয়া থেকেই তো আমরা প্রথম ইমপ্রেশন নেব। মানুষের চোখের কর্নিয়া সব সময় স্থির থাকে।
এনটিভি অনলাইন : এই নতুন ই-পাসপোর্টের জন্য দেওয়া প্রস্তাবনার কার্যক্রম কবে নাগাদ শুরু হতে পারে?
মাসুদ রেজওয়ান : আমরা এই প্রস্তাব দিয়েছি। আশা করি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রস্তাবটির একটা ফয়সালা হয়ে যাবে।
এনটিভি অনলাইন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাসুদ রেজওয়ান : এনটিভি অনলাইনকেও ধন্যবাদ।