নীরবে অনেক বিপর্যয় ঘটে গেছে পাহাড়ে
(প্রায় তিন দশক ধরে দেশের পাহাড়, বন, প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছেন ফিলিপ গাইন। পাহাড়, সমতলের প্রান্তিক মানুষ নিয়েও তাঁর কাজের পরিধি বিস্তৃত। সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউমেন ডেভেলপমেন্ট (সেড) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক তিনি। এ পর্যন্ত ৬০টি বই লিখেছেন তিনি। নির্মাণ করেছেন তথ্যচিত্র। ‘দ্য স্টোলেন ফরেস্ট’, ‘দ্য চিটাগং হিল ট্রাকটস : লাইফ অ্যান্ড নেচার অ্যাট রিসক’, ‘দ্য চিটাগং হিল ট্রাকটস : ম্যান নেচার নেক্সাস টর্ন’, ‘বাংলাদেশের বিপন্ন বন', 'বন বনবিনাশ ও বনবাসীর জীবন সংগ্রাম’ তাঁর উল্লেখযোগ্য বই।
সাম্প্রতিক পাহাড় ধস নিয়ে ফিলিপ গাইন কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সিনিয়র নিউজ রুম এডিটর আহমেদ আল আমীনের সঙ্গে।)
এনটিভি অনলাইন : আবারও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটলো পার্বত্য চট্টগ্রামে। টানা বর্ষণে পাহাড় ধস, এভাবে বলা যাবে? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
ফিলিপ গাইন : দুর্যোগটা আপাতদৃষ্টিতে প্রাকৃতিক। তবে মানুষের কাজের কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটে।
এনটিভি অনলাইন : একটু যদি ব্যাখ্যা করে বলেন-
ফিলিপ গাইন : যেসব জায়গায় ভূমিধস হলো, এখন থেকে ২০ বছর আগেও সেখানে এত জনবসতি ছিল না। শহরই ছিল না। যখন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হয় তখন রাঙামাটি শহর পানিতে তলিয়ে যায়। যেখানে রাঙামাটি শহর ছিল সেখান থেকে এখন যে রাঙামাটি শহর অবস্থিত সেখানে পাহাড় বেয়ে আসতে হতো। অনেক সময় লাগত। এখন যে রাঙামাটি শহর তা উঁচু পাহাড়ের চূড়ায়। এখানে বসতি গড়ে উঠে। সাম্প্রতিক সময়ে বাঙালিদের ঘনবসতি গড়ে ওঠে।
পাহাড়ে জনবসতি গড়ে উঠার ফলে পাহাড়ে কাটছাঁট করা হয়েছে। এটা বালুমাটির পাহাড়। কংক্রিটের নয়। এরপর বৃষ্টি হয়, বালুতে পানি ঢুকেছে। অতি বর্ষণের চাপে ওই বালুমাটির পাহাড় সহ্য করেনি। মানুষ দীর্ঘদিন ধরে যে কাজ করছে তার কারণেই ভূমিধসসহ ত্বরান্বিত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মনে হলেও মানুষের দীর্ঘদিনের কাজের জন্য তা ত্বরান্বিত হয়েছে। নয়তো ভূমিধস হওয়ার কথা নয়।
এনটিভি অনলাইন : তবে পাহাড়কে যদি ঠিকমতো রাখা যেত তাহলে..
ফিলিপ গাইন : ত্রিপুরা থেকে যখন শরণার্থীরা ফিরতে শুরু করে, তখন তাদের পুনর্বাসন করা হয়নি। তারা রাঙামাটি শহরের আশপাশেই পাহাড়ের পাদদেশে ঘর বানিয়ে থেকেছে। এরাই ভূমিধসে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পাহাড়িরা পাহাড়ের গায়ে বাড়ি করে। সেখানে ভূমিধস হয় না। পাহাড়িরা কোনোভাবেই গাছপালা কেটে ফেলেনি। তারা বাঁশ, খুঁটি, গাছ দিয়ে মাচা করে বাড়ি বানায়। কিন্তু রাঙামাটির আশপাশে দিয়ে একেবারে পরিষ্কার করে ফেলেছে। উঁচু পাহাড়েও চাষাবাদ করেছে। যে চাষাবাদ সেখানে যায় না।
এনটিভি অনলাইন : জুম চাষ নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়…
ফিলিপ গাইন : পাহাড়ে গাছপালা থাকতে হবে। জুম চাষ করলে উদ্ভিদ কিন্তু থাকে। প্রজাতির বৈচিত্র্য পাহাড়ে আরো বাড়ে। কেউ কোনোদিন শুনেনি জুম চাষ করলে ভূমিধস হয়। সামান্য টুকটাক হয় যা স্বাভাবিক। কিন্তু রাঙামাটির বিশ থেকে পঁচিশটি জায়গায় এ রকম পাহাড় ধসের ঘটনা আগে দেখা যায়নি। জুম চাষ করলে প্রজাতি বৈচিত্র্য বাড়ে।
এনটিভি অনলাইন : পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের বৈশিষ্ট্যটা কেমন?
ফিলিপ গাইন : পাহাড়ের রেঞ্জটা হিমালয় থেকে শুরু করে মিয়ানমার পর্যন্ত গেছে। মিয়ানমার থেকে চীনের দিকে। উঁচু পাহাড় থেকে আসতে আসতে পাহাড় ছোট হতে আমাদের চট্টগ্রাম পর্যন্ত এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামেরপাহাড়টা নিচু। সেই হিমালয়ের পাথুরে পাহাড় থেকে এসেছে কাদামাটির পাহাড়ে। এ অংশটুকু খুবই স্পর্শকাতর।
এনটিভি অনলাইন : ওই ‘স্পর্শকাতর এলাকার’ অবস্থা কেমন হলো?
ফিলিপ গাইন : এ পাহাড়টা নষ্ট করা ঠিক না। যা হচ্ছে তার জন্য দায়ী পরিকল্পনার অভাব। আইয়ুব খানের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়। সেখানে করা হয় কর্ণফুলী পেপার মিল। ওই কাগজের কারখানা করাতে হয়েছে সর্বনাশ। লাখ লাখ একর জমির বাঁশ কাটা হয়েছে। প্রাকৃতিক গাছ কাটা হয়েছে। পরে বনায়নের নামে গাছ লাগানো হয়েছে। কর্ণফুলী কারখানাকে টিকিয়ে রাখার জন্যই বনায়ন করা হয়েছে।
এখন কর্ণফুলী পেপার ভালো চলছে না। আর কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তো একেবারে ভালো চলছে না। বেশির ভাগ সময়ে এখানে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে না। কিন্তু এ দুইটি কারণে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে চরম অশান্তি তৈরি হয়েছে।
এখন বাঙালিদের বসতি গড়ে উঠছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ছিল আড়াই শতাংশ। ২০১১ সালের জরিপে দেখা গেছে বাঙালি আছে ৪৯ শতাংশ। ভালো করে দেখলে হয়তো বাঙালি এখন পাহাড়িদের চেয়ে বেড়েও যেতে পারে।
এনটিভি অনলাইন : বনায়নের কথা তো বলছে সরকার।
ফিলিপ গাইন : পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ আমল থেকে বনায়ন হচ্ছে। সেগুনের চাষ হয়। সম্প্রতি রাবার, তামাক চাষ হচ্ছে।
বনায়ন করেই পার্বত্য চট্টগ্রাম নষ্ট করা হয়েছে। দেশে একটা বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন আছে। পাকিস্তান আমলে করা। এদের দৃষ্টিতে পাহাড়ের জঙ্গল হচ্ছে বুশ; এটা অপ্রয়োজনীয়। এসব পরিষ্কার করে তারা গাছ লাগিয়েছে। রিজার্ভ ফরেস্ট বানিয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : কী ধরনের বিপর্যয় ঘটছে পার্বত্য চট্টগ্রামে?
ফিলিপ গাইন : পাহাড়ে বালু তোলা হয়। পাথর উত্তোলন হচ্ছে। নানা ধরনের অত্যাচার হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক ঝরণা, অনেক পাহাড়ই নদী নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
কেবল পাহাড় ধসই না এর থেকে অনেক বিপর্যয় আছে। পাহাড় ধস হচ্ছে অনেক বিপর্যয়ের একটা ফল। নীরবে অনেক বিপর্যয় ঘটে গেছে। এগুলো দেখা হয় না।
তামাকের চাষ হচ্ছে। তামাক শুকাতে হয়। তা করতে গিয়ে গাছ কাটা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উন্নয়ন কাজ হয়েছে তা অনেকগুলোই ভুল এবং বিতর্কিত। এসব উন্নয়নকাজে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠী। বিভিন্ন প্রকল্পে সহায়তা করার জন্য এসব দাতাসংস্থা মুখিয়ে থাকে। এখান থেকে তারা নিজেদের সুবিধাও নিয়ে নেয়। টাকাটা ঠিকমতো খরচ হচ্ছে কি না, নাকি অপব্যবহার হচ্ছে- তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
এনটিভি অনলাইন : সমাধান কীভাবে সম্ভব?
ফিলিপ গাইন : গণমাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা শুনেছি ও পড়ছিও। কিন্তু সবাই এখনকার সমস্যা নিয়ে কথা বলছে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিয়ে ভাবতে হবে।
যে বিপর্যয় সেখানে ঘটল, এর সহজ কোনো সমাধান নেই। তারপরও সমাধানের বিষয়টি ভাবতে হবে। পুরো বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান করতে চাইলে প্রয়োজন শক্তিশালী টাস্কফোর্স। যারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। প্রয়োজনে পাহাড় বিশেষজ্ঞদের আনা প্রয়োজন।
পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুসারে যদি শরণার্থীদের বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া যেত, তাহলেও চাপ কমত। সমতলের মানুষের যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। সমতল থেকে যারা গেছে তাদের ঠিকানা সমতলে আছে।
সম্ভবত ১৫/১৬ লাখ মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামে। এত মানুষ না থাকলে ওই এলাকা সুরক্ষিত থাকত।
স্পর্শকাতর জায়গা থেকে মানুষ সরাতে হবে। দেশি প্রজাতির বীজ মাটিতে আছে। তাকে বেড়ে উঠার সুযোগ দিতে হবে। মাটির মধ্যে পাঁচ হাজার বছর পর্যন্ত বীজ থাকে। সঠিক আলো বাতাস পেলে তারা বেড়ে উঠতে পারে। আর এতে বন্ধ হতে পারে ধ্বংসযজ্ঞ।