পানির নিচে লাশ ওপরে মানুষের উচ্ছ্বাস
আষাঢ়ের শুরু থেকে বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে দিন কাটিয়েছে শহর কিংবা গ্রামের মানুষ। কিন্তু আষাঢ়ের ১৪তম দিনে বুধবারের আকাশটা ছিল মেঘমুক্ত। ছিল না প্রখর রৌদ্রের তাপদাহ। ঝিরিঝিরি বাতাস আর থেকে থেকে পদ্মার ঢেউয়ের আওয়াজ অনেককেই সুবর্ণ অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। অথবা দেয় সাময়িক সবুজাভ প্রশান্তি।
এ রকম একটা পরিবেশ ছিল রাজধানীর অদূরে ঢাকার দোহার উপজেলার মৈনটঘাটে পদ্মার পাড়ে, যা অনেকের কাছে মিনি কক্সবাজার নামে পরিচিত।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ঈদের তৃতীয় দিনে আজ বুধবার রাজধানী ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও ফরিদপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ সকাল থেকেই আত্মীয়-স্বজন নিয়ে মৈনটঘাটে জড়ো হন। প্রত্যাশিত স্থানে পৌঁছেই শুরু হয় প্রাণ খোলা উচ্ছ্বাস আর যারপরনাই হৈচৈ। চলে পদ্মা-স্নান আর একেক অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলা। আর পদ্মার পাড়ে বসে তাজা ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়ার অভিলাষ তো আছেই।
অন্যদিকে পদ্মার পাড়ে জড়ো হওয়া জনমানুষ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে পানির স্রোতের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন মধ্যবয়স্ক এক লোক, ঢাকার মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক ড. জামাল উদ্দিন। গত মঙ্গলবার বিকেলে ওই খানে তাঁর একমাত্র ছেলে সালমান বিন জামাল ও ছেলের দুই বন্ধু ডুবে যায়। আজ সকালে ছেলের বন্ধু মহিমের লাশ মিলে। কিন্তু সালমান ও অপর বন্ধু সুপ্রিয়র সন্ধান এখনো মেলেনি।
আহাজারির এক ফাঁকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন জামাল উদ্দিন। তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে কত কান্না জমা আছে তাঁর ভেতরে। সন্তানের কত সুখ-স্মৃতি মনে করে প্রতি মুহূর্তে আহত হচ্ছেন তিনি। পানির ঘূর্ণায়নে কিংবা ডুবুরিদের সহায়তায় সন্তানের লাশ যদি তাঁর সামনে রাখা হয়, তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন তো? অথবা যদি সন্তানের কোনো সন্ধানই না পাওয়া যায় নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরবেন তো?
এমন প্রশ্ন যখন ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনই তিনি বলতে শুরু করেন, “আমার ছেলে সালমান মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ত। আমার একটি মাত্র ছেলে। আমি কী নিয়ে বাঁচব? ছেলে আমাকে বলেছিল, ‘বাবা আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছি।’ এখানে আসবে তা আমি জানতাম না। ওরা কেউ সাঁতার জানে না। শুনেছি, তিনজন পানিতে নেমে গোসলের সময় চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে। আমার যে আর কিছুই থাকল না।”
কথাটা শেষ করতে না করতেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখে উচ্চারিত হলো, আহ! ধ্বনি। এরপরও জামাল উদ্দিন অবলীলায় বলতে থাকেন সন্তানের কত স্মৃতিকথা।
জামাল উদ্দিন বলেন, ‘এখানে ওদের পাঁচ বন্ধু বেড়াতে এসেছিল। ওরা সবাই ছোট বেলা থেকে এক সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। দুজন বাড়ি ফিরে যখন জানাল, আমার সালমান পানিতে ডুবে মারা গেছে তখনই ছুটে আসি। কিন্তু…’ এরপরই থেমে যায় সালমানের বাবার কণ্ঠস্বর।
এ সময় সবার চোখ যায় পদ্মার দিকে। সেখানে একের পর এক নৌকা যাচ্ছে। প্রতিটি নৌকায় চলছে হিন্দি গানের আবহে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার উচ্ছ্বাসমুখর নৃত্য। তারা হয়তো জানেই না, এখানে একদিন আগে কী ঘটেছে। বর্তমানে কী পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পাশেই চলছে ছবি তোলার ধুম। দিন গড়াচ্ছে আর মানুষ বাড়ছে। আগত মানুষের মুখে এ বিষয়ে নেই কোনো শোক কিংবা সহানুভূতি। সবাই নিজে কিংবা নিজের সন্তান-স্বজনের মুখে আনন্দ দেখেই মজা পাচ্ছে।
এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে আসা একদল যুবকের সঙ্গে। আপনাদের মতোই তিনটি প্রাণ এই পদ্মায় ঘুরতে এসে ডুবে গেল গতকাল। এখনো দুজনের সন্ধান মিলেনি। অথচ আপনারা এভাবে আনন্দ করছেন? প্রশ্নটিতে তাদের অনেকেই বিব্রত হলেও একজনের সাদামাটা উত্তর, ‘আমরা আনন্দ করতে এসেছি, তাই আনন্দ করছি। আমরা কি এদের ফিরিয়ে দিতে পারব?’
শিশু-সন্তান নিয়ে সস্ত্রীক ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে আসা ব্যবসায়ী সোহরাব হাসান একই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘এটাই জীবন। কেউ কাঁদবে, কেউ হাসবে। পৃথিবী পৃথিবীর মতো চলবে।’
মৈনট ঘাটে একের পর এক মানুষ আসছে আর যাচ্ছে। এই ঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা খাবার হোটেলসহ নানা পেশাজীবী মানুষ যার যার মতো ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। শুধু অসহায় হয়ে সন্তানদের অপেক্ষায় বসে আছেন বাবা জামাল উদ্দিন।