টিকে থাকতে জামায়াতের নতুন কৌশল
জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রয়েছে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ। বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা এই অপরাধে সাজা পেয়েছেন। কয়েকজনের বিচার চলছে। এ ছাড়া বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাসহ দলটির বিরুদ্ধে বেশ কঠোর মনোভাব রয়েছে সরকার ও সরকারের বাইরে। এসব মোকাবিলা করে টিকে থাকতে দল পরিচালনায় নানা পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরই মধ্যে দলটিতে নতুন সদস্য যুক্ত হওয়ার সংখ্যাও অনেকটাই কমে এসেছে। সেই সঙ্গে দলটির নাম পরিবর্তনের কথাও ভাবা হচ্ছে।
২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। আদালতের আদেশের কারণে নিবন্ধন বাতিলের ফলে দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা হারায় দলটি। নির্বাচন কমিশন বলছে, দলটির গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এখন জামায়াত যদি দেশের গণতান্ত্রিক দৃশ্যপটে আবারও আসতে চায়, তাহলে তাদের সামনে একটিই পথ খোলা আছে। আর সেটা হলো, দলের নাম পরিবর্তন করা এবং নতুন করে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন নেওয়া।
জামায়াতের এক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দলের নাম পরিবর্তন করার জন্য সম্ভাব্য যে নামটি ভাবা হচ্ছে সেটি হলো ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি)। দলের যে অল্প কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ওঠেনি, তাঁদেরই একজন আবদুর রাজ্জাক। নাম পরিবর্তনের এই পরিকল্পনা মূলত তাঁরই। জামায়াতের মধ্য সারির নেতাদের পক্ষ থেকেও সমর্থন পাচ্ছেন আবদুর রাজ্জাক।
তবে নাম পরিবর্তনের এই পরিকল্পনা দলের ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। অনেক নেতা-কর্মী বলছেন, জামায়াত শব্দটাই দলের জন্য এক ধরনের ব্র্যান্ডিং এবং এটা নাম থেকে বাদ দিলে দলটি তার রাজনৈতিক মাধুর্য হারাবে।
জামায়াতের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, দলের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে দলের ভেতরে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। অন্তত তিনি এমনটা জানেন না।
২০১১ সালের ১ সেপ্টেম্বর উইকিলিকসে বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাসের কিছু ফোনালাপ ফাঁস হয়। সেখান থেকে জানা যায়, দল নিষিদ্ধ হওয়া বা নিবন্ধন বাতিল হওয়ার বিষয়ে আশঙ্কা করে জামায়াত আগে থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছিল।
২০১০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টিকে জানিয়েছিলেন প্রয়োজন হলে কীভাবে দলকে পুনর্গঠন করবেন সে পরিকল্পনার কথা।
ওই ফোনালাপে আরো জানা যায়, যদি বাংলাদেশ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে, তাহলে জামায়াত তুরস্কের ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পথ অনুসরণের চেষ্টা করবে। জামায়াত নতুন নাম ধারণ করবে এবং নিজেদের গঠনতন্ত্র থেকে ধর্মীয় মতবাদ বাদ দেবে।
নেতৃত্বে নতুন মুখ
যেহেতু জামায়াতের পুরোনো ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেককেই এখন আর তেমন সক্রিয় দেখা যায় না, সেহেতু জামায়াত এখন নতুনদের নেতৃত্বকে সামনে আনার চেষ্টা করছে।
অতিপরিচিত জামায়াত নেতা গোলাম আযম মারা গেছেন। এ এন এম আবদুর জহির ও শফিকুর রহমানের মতো নেতা বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় দলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারছেন না। দলের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের এরই মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। দলটির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও যুদ্ধাপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন সাজা পেয়ে কারাগারে রয়েছেন।
দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিতে চতুর্থ স্তরের নেতা ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এবং সদস্য সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ আবু তাহের অন্যদের নিয়ে দল পরিচালনা করছেন। এঁরা প্রায় সবাই তুলনামূলক নবীন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা এবং এঁদের বয়স ৪০ থেকে ৫০ এর মধ্যে।
বেশির ভাগ সাবেক শিবিরের সভাপতি এখন জামায়াতের মজলিশে সূরা, নির্বাহী কমিটি ও কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য।
সাবেক শিবির নেতা যাঁরা এখন জামায়তের নেতৃত্বে আছেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি মামলা রয়েছে। যে কারণে বেশির ভাগ উচ্চ এবং মধ্যপর্যায়ের নেতা গ্রেপ্তার এড়াতে লুকিয়ে আছেন। যে কারণে এই মুহূর্তে রাজধানীতে জামায়াতের কোনো উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না।
তবে এটা শুধু রাজধানীর ভেতরের পরিস্থিতি। জামায়াত ও শিবিরের ঢাকার বাইরে থাকা নেতারা বলছেন, পরিস্থিতি এখনো তাঁদের খুব বেশি প্রতিকূলে যায়নি। খুব বেশি সমস্যা ছাড়াই তাঁরা তাঁদের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন।
জরুরি অবস্থা
২০১০ সালের পর থেকে সময়টাকে জরুরি অবস্থা বলে বিবেচনা করছে জামায়াত। দলের একজন কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির নেতা বলেন, ২০১০ সালের পর আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে দল পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহের বিভিন্ন চেষ্টা শুরু হয়।
এই নেতা আরো জানান, সাধারণত রুকন হলো দলের একজন পূর্ণ সদস্য, যিনি বার্ষিকভাবে তাঁর এক মাসের উপার্জন দলের তহবিলে জমা দেন। তবে জরুরি অবস্থা চলার পর থেকে রুকনরা দলের জন্য চাঁদা তুলছেন এবং অন্য কার্যক্রমগুলো সচল রাখছেন। পাশাপাশি অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও দলের জন্য অনুদান দিচ্ছেন।
যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সমাজকল্যাণমন্ত্রী থাকাকালীন অনেক বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে ইসলামিক ল ফোরাম, ইকোনমিক রিসার্চ ব্যুরো, ইসলামী সমাজকল্যাণ সমিতি ও পাঠাগার, বাংলাদেশ মসজিদ মিশনসহ বেশ কিছু সংগঠন।
সূত্র জানায়, এসব বেসরকারি সংস্থা জামায়াতের আর্থিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা ইসলামী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকেও ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এ ছাড়া জেলা কমিটির নেতা যাঁরা বিভিন্ন ব্যবসা ও অন্যান্য কাজে জড়িত, তাঁরাও দলের কল্যাণে অনুদান দিচ্ছেন।
ভালো থাকার অভিনয়
জামায়াতের ঢাকা শহর কমিটির সদস্য জামাল উদ্দিন বলেন, ‘পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। দলের নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে আছে কারণ আমরা প্রকাশ্যে কোনো কার্যক্রম হাতে নিতে পারছি না। সরকার আমাদের দিনের আলোয় কোনো কাজ করতে দিচ্ছে না।’
তবে কয়েকজন নেতা জামাল উদ্দিনের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘দলের সদস্য সংখ্যা বাড়ল কি বাড়ল না সেটা কোনো বড় বিষয় না। এখন জনগণ জামায়াতের বিষয়ে অনেক বেশি সহানুভূতিশীল। সরকারের দমনমূলক কর্মকাণ্ড জামায়াতের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে পরিণত হয়েছে।’
জামায়াতের জনপ্রিয়তার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘সবশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জামায়াতের পক্ষে ৩৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। আপনার কি মনে হয়, আমরা মানুষকে আমাদের পক্ষে ভোট দিতে জোর করি? অথবা এই ৩৬ শতাংশ ভোট কি বাতাসে ভেসে এসেছে? জনপ্রিয়তা আমাদের জন্য কোনো বিষয়ই নয়।’