বিয়ে ঠিক হলো, পাত্রী কে তা জানতাম না
অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার। সম্প্রতি বিচার অঙ্গনে তাঁর ৫০ বছরপূর্তি পালন করেন। বিচার অঙ্গনে মেধা ও যুক্তিতর্ক দিয়ে মামলা জয়ের জন্য তিনি সুনাম ধরে রেখেছেন। আদালতপাড়ায় গরিবের আইনজীবী হিসেবে তিনি খ্যাত। অনেক ত্যাগ, ধৈর্য, কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে তিনি আজ এ পর্যায়ে আসীন হয়েছেন।
এখনো স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন আশি ছুঁই ছুঁই এই স্বপ্নবাজ। আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের সংগঠন সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক ও বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সভাপতি তিনি। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচিত ভাইস-চেয়ারম্যানও।
আইনজীবীদের সবার আর্থিক সঙ্গতি সমান নয় তাদের পরিবারের কথা চিন্তা করে সারাদেশে আইনজীবী সমিতির জন্য ট্রাস্ট গঠন করেছেন বাসেত মজুমদার। গত কয়েক বছরে দেশের ৪৮টি আইনজীবী সমিতির প্রত্যেকটিতে দুই লাখ করে টাকা দিয়েছেন। এর লভ্যাংশ থেকে আইনজীবীদের চিকিৎসায় ব্যয় হবে।
সাধ্যমতো সাধারণ মানুষকে বিনা পয়সায় বা নামমাত্র পারিশ্রমিকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ৫০ বছরের ওকালতি জীবনে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে এভাবে বিনা পয়সায় বা নামমাত্র পারিশ্রমিকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘দুস্থ, অসহায় বিচারপ্রার্থীর জন্য আমার মন কাঁদে। তাদের জন্য সব সময় কিছু করার চেষ্টায় থাকি।’
সম্প্রতি একান্তে কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের নিজস্ব প্রতিবেদক জাকের হোসেনের সঙ্গে। সেখানে তুলে ধরেছেন নিজের বিবাহিত জীবন।
আবদুল বাসেত মজুমদারের বক্তব্য তুলে ধরা হলো
১৯৬৫ সালে আইনজীবী হিসেবে সিনিয়রের সঙ্গে কাজ করার সময়ে আবদুস সালামের (সুপ্রিম কোর্টের প্রয়াত আইনজীবী) স্ত্রীর বোনের মেয়ে রওশন জাহান মেহেরুন নেসার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। ওই সময়টা বিয়ে নিয়ে তখন চিন্তাও করিনি। কারণ, পকেটে টাকা নেই, ঢাকায় নিজের থাকার মতো নিজের কোনো বাসা নেই।
সূত্রাপুরে এক বন্ধুর মেসে ভাগাভাগি করে থাকতাম। কিন্তু আমার সিনিয়র (আবদুস সালাম) ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর স্ত্রী আমাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। পরে তাঁর বোনের মেয়ের জন্য আমার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করলেন। আমি জানতাম না।
আইনজীবী সালাম সাহেব একদিন আমাকে ডেকে বললেন, তোমার বাড়ির ঠিকানাটা দাও। আমি ঠিকানা দিলে তিনি হঠাৎ একদিন আমাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে গিয়ে হাজির হলেন। উনি আমাদের পারিবারিক আইনজীবী ছিলেন বিধায় বাবার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। কিন্তু হঠাৎ আমাদের বাড়িতে যাওয়ায় আমার বাবা চিন্তায় পড়ে গেলেন; ছেলের সঙ্গে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না?
বাবা আয়েশ করে উনাকে মেহমানদারি করার পর বাবা বললেন, স্যার আমার ছেলের সঙ্গে কোনো সমস্যা হয়েছে কি? বাবার কথার জবাবে আমার সিনিয়র সালাম সাহেব বাবাকে বললেন, আপনার ছেলের সঙ্গে আমাদের একটি মেয়ের বিয়ে দিতে চাই। আপনি কি বলেন? জবাবে বাবা শুনেই রাজি হয়ে গেলেন। এরপর বিয়ের বিষয়ে তাঁরা কথা বার্তা বলতে লাগলেন। কিন্তু আমি তখনো মেয়ে দেখিনি।
একদিন চিন্তা করলাম, কী রকম মেয়ে বিয়ে করছি। কি অবস্থা একটু দেখা দরকার। পরে মেয়েদের গ্রামের বাড়িতে গেলাম। দেখে পছন্দ-অপছন্দ দুটোই হলো। কিন্তু চিন্তা করছিলাম এ অবস্থায় বিয়ে করব কি না? পরে আমার এক বন্ধু আবদুল মালেকের পরামর্শে রাজি হলাম। ১৯৬৫ সালের অক্টোবরে আমাদের বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর বউকে ঢাকায় আনতে পারলাম না। আমি সূত্রাপুরে এক বন্ধুর মেসে ভাগাভাগি করে থাকতাম। বউ থাকত তাঁর বাবার বাড়ি।
আর্থিক ভঙ্গুরদশা সত্ত্বেও আমার শ্বশুরপক্ষ আমার কাছে বিয়ে দেওয়ার পেছনে কারণ ছিল, অভাব-অনটন সত্ত্বেও দিনরাত মামলার কাজ করতাম। সিনিয়র আমাকে কী টাকা দিল, সেটা নিয়ে ভাবতাম না। আমার এ ধৈর্য দেখে আমার সিনিয়র মুগ্ধ ছিলেন। তিনি বলতেন, তুমি অনেক বড় আইনজীবী হবে।
পরে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে নিবন্ধিত হয়ে ১৯৬৬ সালে ঢাকা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। এই সময়টা আমার জীবনে অনেক কঠিন সময় ছিল। ওই সময়টা তেমন আয় ছিল না, তবে ব্যয় ছিল। আবার বাবার কাছেও টাকা চাইতে পারতাম না, আত্মসম্মানে বাধে। সব মিলিয়ে কঠিনভাবেই পাড় করেছি ওই সময়। আর্থিক অনটন ও দারিদ্র্যের সঙ্গে কাটিয়েছি দিনগুলো। তবে জীবনে পালাবার পথ খুঁজিনি। ওই সময় বাবার ব্যবসা ভালো ছিল না। উনি বৃদ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর ওপর ছয়বোনসহ অনেক বড় পরিবার ছিল। পরিবারেও কিছুটা অভাব অনটন চলছিল। বাবা মাঝে মধ্যে আকারে-ইঙ্গিতে সংসারে টাকা পাঠানোর কথা বলতেন। কিন্তু টাকা দিতে পারতাম না বিধায় বাড়িতে যেতাম না। বউ থাকত তাঁর বাবার বাড়িতে, সেখানে মাঝেমধ্যে বেড়াতে যেতাম। অথবা বাড়িতে যাওয়ার সময় নিয়ে যেতাম। আবার ঢাকা আসার সময় তাঁর বাবার বাড়িতে রেখে আসতাম। এভাবে চলছিল। পরে আস্তে আস্তে কিছুটা আয় বাড়তে থাকে। ১৯৭১ সালে তাঁতি বাজার এলকায় ৩০০ টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া নিলাম।
খালু শ্বশুরের বাড়ি ভাড়া নিলাম। বউকে নিয়ে উঠলাম ওই বাসায়। সালাম সাহেব মূলত বাবার আইনজীবী ছিলেন। বাবার মহুরি আমাকে সালাম সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপরে তাঁর সঙ্গে কাজ শুরু করি।