‘শৈশবে গান্ধীকে দেখেছিলাম এক নজর’
অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার। বিচার অঙ্গনে সম্প্রতি তাঁর ৫০ বছরপূর্তি পালন করেন। বিচারঙ্গনে মেধা ও মনোমুগ্ধকর যুক্তিতর্ক দিয়ে মামলা জয়ের জন্য তিনি পরিচিত। আদালতপাড়ায় গরিবের আইনজীবী হিসেবে তিনি বেশি বিখ্যাত। অনেক ত্যাগ, ধৈর্য, কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে তিনি আজ এ পর্যায়ে আসীন হয়েছেন। স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন স্বপ্নবাজ এই আশি ছুঁই ছুঁই তরুণ। আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের সংগঠন সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক ও বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সভাপতি। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচিত ভাইস-চেয়ারম্যান। নিজের জীবনের কিছু ঘটনা নিয়ে কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে।
গান্ধী দর্শন
আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে নোয়াখালীতে ভয়াবহ দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এ সময় নোয়াখালীতে আসেন ভারতের অন্যতম নেতা মহাত্মা গান্ধী। গান্ধী আসবেন শুনে আমাদের এলাকাও উত্তেজিত। এলাকার ওপর দিয়ে গেছে রেললাইন। আর আছে লাকসাম স্টেশন। স্টেশনে থামবে গান্ধীর ট্রেন! ভিড় জমে গেল লাকসাম স্টেশনে।
আমাদের স্কুলের শিক্ষকরা সব ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে লাকসাম ট্রেন স্টেশনে গান্ধীকে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। আমার মনে আছে হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রীদের ভিড়ে আমি দেখতে পারছিলাম না। গান্ধীর ট্রেন যখন স্টেশন স্পর্শ করল তখনো কিছু দেখতে পারছিলাম না। আমার এক শিক্ষক আমাকে তাঁর কাঁধের ওপর নিয়ে আমাকে দেখালেন। আমি এক নজর দেখলাম মহাত্মা গান্ধী ট্রেনের জানালা দিয়ে হাত নেড়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। দেখে ভাবলাম এই সেই ব্যক্তি যার জন্য হাজার মানুষ অপেক্ষা করছে। আমার ওই চিত্র এখনো চোখের সামনে ভাসে। মজার বিষয় হলো ওই হুবহু চিত্র প্রায় ৬৫-৭০ বছর পর যখন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচনী কাজে নোয়াখালী সফর করলাম। পরে সেখানে গান্ধী আশ্রম দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে গান্ধীর যে ছবি দেখেছি ঠিক হুবহু সেই ছবি তার আশ্রমে ঝুলছে! আমি আরো অভির্ভূত হলাম। এটি আমার জীবনের স্মরণীয় দিন।
১৯৭১-এর মার্চের দিনগুলো
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চলে এল ১৯৭১ এর কথা। ওই বছর মার্চে তিনি ঢাকাতেই ছিলেন। আবার কিছু সময় বাড়িতেও ছিলেন। আবদুল বাসেত জানালেন, তাঁর পরিষ্কার মনে আছে মার্চের ঘটনাগুলো।
আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘১৯৭১ সালের দিকে মালিটোলা একটা জাগায় বাসা ভাড়া নিলাম। মালিটোলা আমার বাসার কাছে ২৬ মার্চ হঠাৎ বিকেলে দেখি চর্তুদিকে কেমন অস্থির পরিস্থিতি। সবাই কেমন যেন শুধু পালানোর জন্য ব্যস্ত। আমি রাস্তা থেকে দ্রুত বাসায় উঠলাম।বউকে বললাম সব জায়গায় যেন কেমন গম্ভীর ভাব। রাতের বেলায় ঘুমাতে যাবো এমন অবস্থায় হৈচৈ আর চিৎকার শুনে বের হলাম। তাঁতী বাজার ,বংশাল এলাকায় দেখলাম হঠাৎ আগুন আগুন চিৎকার। আর জীবন্ত দগ্ধ মানুষের আহাজারি। আমি যে বাড়ীতে ছিলাম তা ছিলো অবসরপ্রাপ্ত সাবেক সেনা কর্মকর্তা জোবাইদ আলী ভূঁইয়ার বাড়ি। ওই বাড়িতে সেনাসদস্যরা খোঁজ নিতে এসেছিল। যখন বাড়ির সামেন ফটকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা-কর্মকর্তার বাড়ি লেখা দেখলো; তখন পাক আর্মিরা আর ওই বাড়িতে হামলা করেনি। পরেরদিন সকালে তাঁতীবাজার এলাকা থেকে খালু শ্বশুড়ের বাসায় উঠলাম। তখন আমার এক ছেলে এক মেয়ে ছিল। রাস্তায় ৮-১০ লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। তাঁতীবাজার এলকায় দেখলাম এক ব্যক্তিকে দেখলাম হঠাৎ আমার কাছে একটি কাপড়ের পোটলা নিয়ে হাজির হয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করতেই বললো স্বর্ণ-অলংকার আছে এখানে। কোথায় পেয়েছ জিজ্ঞাসা করতেই বলল; আমি একটি হিন্দু বাড়িতে কাজ করতাম। তারা সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। ঘরের একটি রুমে দেখলাম নিচের দিকের একটি ইট উঠানো অবস্থায় রয়েছে। পরে ইটটি উঠানোর পর মাটির নিচে এ পোটলাটি দেখলাম। আমি ও আমার সঙ্গে থাকা আরো একজন মিলে নিয়ে আসলাম। এখন রাখার জায়গা নেই। আপনার কাছে রেখে গেলাম। পরে এসে আমরা নিয়ে যাব। পরে এসে নিয়ে গেল।
বাসেত মজুমদার বলেন, ‘পরে জানলাম ওই পোটলার জন্য সে অন্য এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেছে। এভাবে দেখলাম গণহারে লুটতরাজ চলছে।
পরে তাঁতীবাজার এলাকা থেকে একেএম ফজলুল হক সাহেবের বাড়ির পেছনে এক আইনজীবীর বাড়িতে উঠলাম। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র স্বচোখে দেখেছি। কিন্তু আমি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করিনি। যুদ্ধকালীন বাড়িতে থাকাটাও নিরাপদ মনে করিনি। কারণ বাড়ির পাশে লাকসাম রেললাইন মুক্তিযোদ্ধারা বোমা মেরে উল্টিয়ে দিত। তখন সেনাসদস্যরা রেললাইন এলাকার বাড়িগুলোতে এসে হামলা করত। এ কারণে বাড়ি থাকা হতো না। এভাবে ঢাকা-বাড়ি মিলে মুক্তিযুদ্ধের সময় পার করলাম।’