ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও এতটা হয়নি
অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মীদের মামলা পরিচালনা করেন তিনি। ৩২ বছরের আইন পেশায় ২০ হাজারের বেশি মামলার শুনানিতে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে অংশ নিয়েছেন, যা ঢাকা বারের আইনজীবীদের ব্যক্তিগত ইতিহাসে রেকর্ড। বতর্মানে তাঁর নিজ চেম্বারে (আইনি ব্যবসার প্রতিষ্ঠান) প্রায় দুই হাজার মামলা রয়েছে। নিজের মামলা ছাড়াও বিএনপি সমর্থক অন্য আইনজীবীদের মামলার শুনানিতেও তিনি নিয়মিত অংশ নেন। কোনো কোনো দিন ৩০টির বেশি মামলার শুনানিও করতে হয় তাঁকে।
সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে ব্যক্তিগত জীবন, মুক্তিযুদ্ধে অবদান, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক জীবন নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন বিশিষ্ট এ আইনজীবী।
সানাউল্লাহ মিয়ার জন্ম ১৯৫৫ সালের ১০ জানুয়ারি। তবে সনদে ১০ জানুয়ারি ১৯৬০। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘এটি আমার ইংরেজি শিক্ষকের দেওয়া জন্ম সাল।’
বাবার নাম আব্দুল খালেক মিয়া, মা কানেছা বেগম। গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুর থানার দক্ষিণ কারারচর। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী, আর মা গৃহিণী। দুজনই মারা গেছেন। পাঁচ ভাই, তিন বোন তাঁরা। বর্তমানে চার ভাই বেঁচে আছেন।
সানাউল্লাহ মিয়ার দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে শফিকুর রহমান, ছোট ছেলে শিবলী রহমান এবং একমাত্র মেয়ে সাবরিনা রহমান।
এনটিভি অনলাইন : গ্রামেই তো শিক্ষাজীবনের শুরু আপনার।
অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া : হ্যাঁ, গ্রামের বাড়ি কারারচর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু। শৈশবে প্রাইমারি স্কুলে আমরা পাতিলের কালি দিয়ে কলাপাতায় লিখতাম। তখন কাগজের তেমন চল ছিল না। জিংলা দিয়ে তৈরি কলম ব্যবহার করতাম। পড়ালেখার প্রাথমিক জীবন শেষ করে স্থানীয় সাটিরপাড়া কালীকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। হাইস্কুলে পড়ার সময়ই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের কারণে পড়ালেখা কয়েক বছর অনিয়মিত হয়ে যায়। পরে ১৯৭৫ সালে ওই স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পাস করি। ১৯৭৭ সালে নরসিংদী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৭৯ সালে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করি। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্সে ভর্তি হই। একই সময়ে আমি ঢাকা সিটি ল’ কলেজে ভর্তি হলাম। পরে ১৯৮৫ সালে মাস্টার্স এবং এলএলবি পাস করি।
এনটিভি অনলাইন : আপনি স্কুলে পড়ার সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু, অংশ নিয়েছিলেন?
সানাউল্লাহ মিয়া : আমার বয়স তখন চৌদ্দ কিংবা পনেরো হবে। তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। এ বয়সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার জন্য নরসিংদী থেকে লুঙ্গি পরে ট্রেনে করে ঢাকায় চলে আসি। ভাষণের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হয়ে গেলাম। সে সময় মেজর জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা, রেডিওতে চরমপত্র, আপেল মাহমুদের গান শুনে যুদ্ধের অনুপ্রেরণা পাই। এ ছাড়া পাক বাহিনী আমাদের বাড়ির পাশে বোমা বর্ষণ করে। এসব ভয়ানক দৃশ্য দেখে দেশপ্রেম জেগে ওঠে। যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠি।
আমাদের গ্রামের ২৫ জন সহপাঠী একসাথে একরাতে শিবপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেই। বয়স ও শরীরের গড়ন ছোট হওয়ায় প্রথমে সেখানকার কেউ আমাকে প্রশিক্ষণে নিতে রাজি হয়নি। পরে আমার প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে প্রশিক্ষণে নেওয়া হয়। সেখানে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিই এবং অস্ত্র পরিচালনা শিখি। এরপর ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে নরসিংদীর রায়পুরা থানায় একটি যুদ্ধে আমি সরাসরি অংশগ্রহণ করি।
এনটিভি অনলাইন : মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কোন ঘটনাগুলো আপনার আজও মনে পড়ে?
সানাউল্লাহ মিয়া : নরসিংদীর কালীগঞ্জ থানা এলাকায় একবার পাক আর্মি আমাদের তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তাদের হাতে প্রায় ধরা পড়েই গিয়েছিলাম। তখন আমরা চুতরাপাতা মাথায় ও শরীরে জড়িয়ে জংলি সেজে একটি বাগানের ভেতর দিয়ে পিছু হটি। চুতরাপাতা গায়ে লাগলে শরীর ফুলে যেত। কিন্তু উপায় না দেখে সেগুলোই গায়ে জড়িয়ে নিই। এরপর নদী দিয়ে সাঁতার কেটে আমরা কৌশলে পালাই। পাক আর্মি আমাদের ধরতে ব্যর্থ হয়।
যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গ্রামের মানুষের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা ছিল মনে রাখার মতো। তারাই আমাদের খাওয়াত। এমনও হয়েছে গ্রামের মানুষ আমাদের খাসি ছাগল জবাই করে খাওয়াত। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গ্রামের মানুষ অনেক সময় ঘরে কাঁঠাল, আম এবং রান্না করে খাবার রেখে দিত। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দেশের মানুষের ভালোবাসা আমাকে খুবই নাড়া দিয়েছিল।
যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাড়িতে ফিরি। তখন যোগাযোগের কোনো মাধ্যম ছিল না। আমি বেঁচে আছি কি না সে চিন্তায় মা-বাবা অস্থির ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর রেসকোর্স ময়দানে শিবপুরের সব মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমিও অস্ত্র জমা দিই।
এনটিভি অনলাইন : মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। কিন্তু আপনি যুক্ত হলেন বিএনপির সাথে…
সানাউল্লাহ মিয়া : বঙ্গবন্ধু যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন দেশে শুধু অভাব আর অভাব। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে তীব্র খাদ্য সংকটই নয়, গায়ের জামার সংকটও বিরাজ করছিল। পরিবেশ বলতে কিছুই ছিল না। দেশের সব জায়গায় দিনে-দুপুরে ঘটত চুরি-ডাকাতি। এর মধ্যে একবার বন্যা হলে অভাবের তীব্রতা বেড়ে যায়। শুধু আমাদের ঘরেই পাঁচবার ডাকাতি হলো। সব কিছু নিয়ে যায় ডাকাতেরা, রান্নাঘরের পাতিলও বাদ পড়েনি। আমার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এমন কেউ বাদ ছিল না তাদের ঘরে ডাকাতি হয়নি। সারা দেশে ডাকাতি হচ্ছিল। তখন দেশের মানুষ ক্ষমতাসীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর বিরক্ত হচ্ছিল, তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা কমতে শুরু করে। আমরা পুরো পরিবার ছিলাম বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। কিন্তু তখনকার সময়ের পরিস্থিতির কারণে সবাই বলতে শুরু করল এ জন্য কি আমরা দেশ স্বাধীন করেছি?
আমি বর্তমান রাজনীতিবিদ হিসেবে না, তখনকার একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বলছি, শেখ মুজিবুর রহমান যে সরকার গঠন করেছিলেন, তারা দেশ চালাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ক্ষমতাসীনদের অনেকে লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই আফসোস করে বলেছিলেন, আমার চারপাশে শুধু চোর আর চোর।
তখন আমরাও তো আওয়ামী লীগে ছিলাম, নৌকায় ভোট দিতাম। ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে নৌকায় ভোট দিয়েছি। মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন আমার এলাকার নেতা। তিনি ন্যাপ থেকে নির্বাচন করতেন। আমরা কিন্তু তাঁকে ভোট দিইনি। তখনো নৌকায় ভোট দিতাম। কিন্তু তখনকার দেশের অরাজক পরিস্থিতির কারণে অনেকের মতো আমরাও ক্ষমতাসীনদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই।
এনটিভি অনলাইন : বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে?
সানাউল্লাহ মিয়া : ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাছাই করা ছাত্রদের নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সম্মেলন করেন। আমি তখন সোহরাওয়ার্দী কলেজে ডিগ্রিতে পড়ি। কলেজের ২০ জন ছাত্র নিয়ে আমিও ওই সম্মেলনে যোগদান করি। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ওই সম্মেলন থেকেই ছাত্রদলের উৎপত্তি হয়।
সেখানে কলেজের পক্ষ থেকে দলনেতা হিসেবে বক্তব্য দেই। আমার ওই বক্তব্য জিয়াউর রহমান মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং এর পর থেকেই তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ওই সম্মেলনের পর ১৯৭৯ সালে ঢাকা সিটি কলেজে ল’ পড়ার সময়ে আমাকে ওই কলেজের জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক হই। ১৯৮০ সালে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি করা হয়, আমি ওই কমিটির সদস্য ছিলাম। ১৯৮২ সালে আমাকে ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে আমাকে ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য করা হয়। ১৯৮৫ সালের ৩ মার্চ আইনজীবী হওয়ার পর আমি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর সহ-আইন সম্পাদক ছিলাম। এরপর ১৯৯৩ সালে ঢাকা মহানগরীর আইন সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালে তিন মাসের জন্য ঢাকা জজকোর্টে আমাকে বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই সময় আমার দায়িত্ব ছিল এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করা।
এনটিভি অনলাইন : পেশা হিসেবে কেন আইন বেছে নিলেন?
সানাউল্লাহ মিয়া : রাজনীতি করব বলে লক্ষ্য স্থির করেছিলাম। আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও আইন নিয়ে পড়াশোনা করে দেখেছি পৃথিবীর বর্ষীয়ান নেতাদের বেশির ভাগই ছিলেন আইনজ্ঞ। আমারও ইচ্ছে ছিল আমি রাজনীতি করব। রাজনীতি করতে হলে আইন পেশায় থাকাটা জরুরি। তাই আইন পেশায় জড়িত হলাম। তবে এখন মনে করি, অসহায় এবং মানবসেবার জন্য এটি একটি উৎকৃষ্ট জায়গা।
আইনজীবী হওয়ার পর আমি সাধারণ মানুষের পাশাপাশি জুনিয়র আইনজীবীদের মামলাও সিনিয়র হিসেবে বিনা পয়সায় পরিচালনা করেছি। এ কারণে আমি আদালত অঙ্গনে জনপ্রিয় হয়ে উঠি এবং ২০১০ সালে আমি ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হই।
২০১২ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হই। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সদস্য এবং ২০১৫ সালে আমি আবার বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হই।
আসলে নেত্বত্ব দেওয়া এবং মানুষের সেবা করার কাজটি আমি মূলত গ্রামে থাকার সময় থেকেই শুরু করি। তাঁতি সমিতির মাধ্যমে গ্রামে সেবামূলক কাজ শুরু করি। গ্রামের বিত্তবানদের কাছ থেকে সুতা উঠিয়ে গরিবদের মাঝে বিতরণ করতাম। এখন বিএনপির আইন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
এনটিভি অনলাইন : খেলাধুলা অত্যন্ত পছন্দ করতেন বলে শুনেছি...
সানাউল্লাহ মিয়া : (হেসে) ফুটবল খেলা আমার খুব পছন্দের। ছোটবেলা থেকেই আমি ফুটবল-পাগল। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সব সময়ই খেলতাম। হাত-পা ভেঙে বাড়ি ফিরে বহুবার মা-বাবার বকা খেয়েছি। তবে ফুটবল খেলা ছাড়তে পারিনি। এখন প্রতিবছর জাতীয় ঈদগাহে হাইকোর্টের আইনজীবী ও বিচারপতিদের মধ্যে প্রীতি ফুটবল খেলা হয়, সেখানে আমি খেলি।
এনটিভি অনলাইন : ছোটবেলার কোনো মজার ঘটনা…
সানাউল্লাহ মিয়া : আমার এলাকায় সানোয়ার হোসেন নামে আমার এক বন্ধু ছিল। এলাকায় সবাই আমার মতো তাকেও সানা নামে ডাকে। একদিন রক্ষী বাহিনীর লোকজন কোনো একটি অপরাধের ঘটনায় তাকে খুঁজতে গ্রামে আসে। কিন্তু আমার নামের সঙ্গে মিল থাকায় গ্রামের লোকজন ভুল করে রক্ষীবাহিনীকে আমার বাড়ি দেখিয়ে দেয়। আমি যখন দেখলাম রক্ষীবাহিনী আসছে তখন বাড়ির পেছনে দিয়ে ভোঁ-দৌড় দিলাম। এরপর সাঁতার কেটে নদী পার হয়ে পালিয়ে যাই। সে যাত্রায় কোনো রকমে বেঁচে যাই। জীবনে আর কখনো এত জোরে দৌড় দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। দুদিন পর বাড়ি ফিরে শুনি আমাকে নয়, আমার বন্ধু খুঁজতে এসেছিল।
এনটিভি অনলাইন : সত্তরের দশকের শেষ দিকে আপনি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলেন…
সানাউল্লাহ মিয়া : হ্যাঁ, ১৯৭৭ সাল থেকে ঢাকায় বসবাস শুরু করি। ১৯৮৫ সালের আগ পর্যন্ত টিউশনি করে উপার্জন করতাম। এই টাকার অর্ধেক নিজের জন্য রাখতাম, বাকি অর্ধেক মায়ের জন্য বাড়িতে পাঠাতাম। ঢাকায় আমি নবাবপুরে যে আত্মীয়ের বাসায় থাকতাম, তারা আমার খাওয়ার টাকা নিত না।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় গুলিস্তানে মিছিল মিটিং করতাম। তখন পুলিশ বাসায় ডিস্টার্ব করতে। পরে ফকিরাপুলের এই চেম্বার (বর্তমান প্রতিষ্ঠান) ভাড়া করলাম, এখানেই রাতে ঘুমাতাম।
১৯৮৩ সালে বড় ভাইয়ের মাধ্যমে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে হয়। আমার স্ত্রীর বাড়ি মানিকগঞ্জে, তিনি একটি বিউটি পার্লার চালাতেন। বিয়েতে তেমন কেউ উপস্থিত ছিলেন না।
এনটিভি অনলাইন : কীভাবে আইন পেশায়?
সানাউল্লাহ মিয়া : ১৯৮৫ সালে খালেদা জিয়া ঢাকা বারে আসেন। আমার সিনিয়র আইনজীবী ছিলেন আবদুর রেজ্জাক খান, তিনি ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করতেন। আমি তাঁর সাথে মামলা পরিচালনা করতাম। একদিন এক ব্যক্তি আমাকে বললেন, ১০ হাজার টাকা দেব, জামিনের ব্যবস্থা করতে হবে। তখন আমি আবদুর রেজ্জাক খানকে বললাম, ওই ব্যক্তির জামিনের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বললেন, জামিনের দরকার? আমি বললাম, হ্যাঁ, জামিনের ব্যবস্থা করতে পারলে ১০ হাজার টাকা পাব।
পরে রেজ্জাক খান আমাকে লাল মিয়া নামে একজন মুক্তারের (বঙ্গবন্ধু আইনি সনদ ছাড়া কিছু ব্যক্তিকে ফৌজদারি মামলা পরিচালনার অনুমতি দিয়েছিলেন) কাছে নিয়ে গেলেন। মুক্তারের মাধ্যমে জামিন হয়ে গেল। তখন আমি ভাবতে লাগলাম, আমি একজন আইনজীবী হয়েও মুক্তারের কাছে ধরণা দিতে হলো! এই ঘটনার পর ফৌজদারি মামলার প্রতি অবজ্ঞা চলে এলো, এ ধরনের মামলা পরিচালনা থেকে সরে এলাম।
পরে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহর বাবার সঙ্গে কাজ করতে লাগলাম। তিনি ছিলেন নামকরা দেওয়ানি আইনজীবী। এভাবে দিন যাচ্ছিল। ফকিরাপুলের এই জায়গায় চেম্বার ছিল। ঢাকা এবং হাইকোর্টের সব আদালত আমার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে খালেদা জিয়া এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকার মামলা দেওয়া শুরু করল। তখন খালেদা জিয়া এসব মামলা পরিচালনার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেন। এরপর ১৯৯৬ সালে আবার ফৌজদারি মামলা পরিচালনা শুরু করি। তখন থেকেই নিম্ন আদালতে ফৌজদারি মামলার আইনজীবী হিসেবে আমার পরিচিতি গড়ে ওঠে।
এনটিভি অনলাইন : আদালতপাড়ায় তো এখন আপনাকে সবাই এক নামে চেনেন…
সানাউল্লাহ মিয়া : একটা মজার ঘটনা বলি। ‘স্বাধীনতা’ নামের একটি চলচ্চিত্রে অভিনেতা আহমেদ শরীফ এক সংলাপে বলেন, ‘জামিন যদি পেতে চাও আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়ার কাছে যাও’। সেই সিনেমা মুক্তির পর দেখি সারা দেশে, শহরে, গ্রামে-গঞ্জে, ছোট-বড় সবার মুখে মুখে এই সংলাপ। এমনভাবেই সারা দেশে আমার নাম ছড়িয়ে পড়ে, এখন এক নামে সারা দেশের মানুষ আমাকে চেনেন। এখন আমি নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টে ফৌজদারি মামলা লড়ি। তবে দেওয়ানি মামলাও আমি ভালো বুঝি।
এনটিভি অনলাইন : আপনাকে দলীয় নেতাকর্মীদের মামলা বেশি পরিচালনা করতে দেখা যায়।
সানাউল্লাহ মিয়া : ঠিকই বলেছেন, আমি এ পর্যন্ত বিনা পয়সায় প্রায় ২০ হাজার মামলা পরিচালনা করেছি। তার মধ্যে নেতাকর্মী এবং দেশের অসহায় মানুষের মামলাও আছে।
এক-এগারো এবং তার আগে-পরে বেগম জিয়ার মাধ্যমে ফৌজদারি আইনজীবী হিসেবে আমার পরিচিতি গড়ে ওঠে। বেগম জিয়া আমাকে ফৌজদারি আইনজীবী বানালেন, আমি আর দেওয়ানি আইনজীবী হতে পারিনি। এখন আমি কোনো কোর্টে দেওয়ানি মামলা নিয়ে গেলে বিচারক বলে ওঠেন আপনি তো ফৌজদারি আইনজীবী, এখানে এলেন কেন?
আমি মূলত সবাইকে আইনগত সহায়তা দিয়েছি। তার মধ্যে বেগম জিয়া থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ আছেন। আমার কাছে যিনি এসেছেন, আইনজীবী হিসেবে চেষ্টা করেছি তাদের সাহায্য করার জন্য। তবে খারাপ লাগে যখন দেখি, যেসব ছেলেকে আমি ছোট দেখেছি, এখন দেখি সে আমার চেয়েও বৃদ্ধ হয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে সরকার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ধরে ধরে এত বেশি নির্যাতন করেছে যে, এসব নেতাকর্মীর চেহারা পাল্টে গেছে।
এনটিভি অনলাইন : আইন পেশায় সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছেন কখন?
সানাউল্লাহ মিয়া : বিগত ওয়ান-ইলেভেনের সময়টা ছিল সবচেয়ে কঠিন, ভয়ানক। তখনকার সময়ের কিছু কথা বলি। বেগম জিয়াকে ধমক দিয়ে বলা হলো, তাঁকে দেশের বাইরে পাঠানো হবে। টিকেট, ফ্লাইট সবই রেডি। ম্যাডাম আমাকে ফোন করলেন। বললেন, সানাউল্লাহ আমাকে তো দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে। তখন আমি বললাম, ম্যাডাম আপনি যদি দেশের বাইরে চলে যান তাহলে এ সরকারকে কোনোভাবেই ক্ষমতা থেকে নামানো যাবে না। আপনি কোনোভাবেই বিদেশে যাবেন না।
পরে আরেকদিন রাত ৩টার দিকে ম্যাডাম আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, সানাউল্লাহ আমাকে ওরা দেশের বাইরে পাঠাবে না, বরং কোর্টে নিয়ে যাচ্ছে। তুমি চলে এসো। আমি বললাম, ম্যাডাম আপনি চিন্তা করবেন না, সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি। পরে আজানের আগে ভোর বেলায় অর্ধশতাধিক আইনজীবী নিয়ে হাজির হলাম আদালত প্রাঙ্গণে। একই সঙ্গে কিছু মিডিয়াকেও জানালাম। একই দিন যখন হুইল চেয়ারে করে আরাফাত রহমান কোকোকেও আদালতে আনা হলো। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) তাঁকে দেখলেন। দেখে বিমর্ষ হয়ে ছটফট করতে শুরু করলেন। তিনি আগে বুঝতে পারেননি যে, কোকোসহ সবাইকে এত নির্যাতন করা হয়েছে। ম্যাডামের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। পরে বিচারক যখন দেখলেন, ম্যাডাম জিয়া বিষয়টি দেখে ছটফট করছেন, কিছু বলতে পারছেন না। পরে আদালত দ্রুত কোকোকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
একই অবস্থা হয়েছিল তারেক রহমানের ক্ষেত্রেও। আদালতে একদিন আনার পর তিনি তো আর হাঁটতে পারলেন না।
এসব নির্যাতনের কারণে কোকো তো মারাই গেলেন। বেগম জিয়ার জন্য এটি ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। তাঁর যে দেশপ্রেম এটি আপনি কীভাবে দেখবেন? আমার চেয়ে আর বড় সাক্ষী আর কেউ নেই। ওই সব দিনের কথা মনে পড়লে শরীর শিউরে ওঠে।
এনটিভি অনলাইন : আদালতে মামলার পরিচালনার সময় বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে কি?
সানাউল্লাহ মিয়া : আদালতে আমি প্রথমে চিন্তা করি বিচারকের কাছ থেকে কীভাবে বেনিফিট নিতে হবে। জজসাহেব কীভাবে কনভিন্সড হবেন বা আমার পক্ষে রায় দেবেন আমি সাধারণত সেসব তথ্য শুনানিতে তুলে ধরি। আমি ১/১১-এর সময় আদালতে দেখেছি, কামাল মজুমদার, লোটাস কামাল অসুস্থ হলেন। তখন তাঁদের শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁরাও যেন অসুস্থ হয়ে যান, তাহলে জামিন পাবেন। পরে তাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেলেন। তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে, কোনো বিচারক জামিন দেওয়ার সাহস পাচ্ছিলেন না। পরে বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মো. মোমিনুর রহমান এ বিচারপতি শরীফ উদ্দিন চাকলাদার জামিন দেওয়া শুরু করলেন। পরে একে একে সবাই জামিন পেতে শুরু করলেন। হাইকোর্ট থেকে একে একে সবাই জামিন পেলেন।
এখন আমরা সে মুক্তি আর আগের মতো পাচ্ছি না। এখন বেশির ভাগই বিচারপতির কাজেই আইন মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করে। আজকে পুরো বিচার বিভাগ জিম্মি হয়ে গেছে। যদিও প্রধান বিচারপতি মাঝে মাঝে ভালো কথা বলেন। বিরোধী দল আদালত থেকে এখন যেভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে, ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও এতেটা হয়নি।
এনটিভি অনলাইন : দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, নির্বাচন এসব সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
সানাউল্লাহ মিয়া : আইনের বিধান অনুযায়ী যদি আপনি দেখেন, তাহলে পৃথিবীর কোথাও বাংলাদেশের মতো একটি পার্লামেন্ট থাকতে আরেকটি নির্বাচন করার নিয়ম নেই। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে হলে আপনি যে পদে নির্বাচন করবেন, সে পদকে শূন্য ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু এ দেশে কী হচ্ছে? ধরুন, রাজধানীর মতিঝিল আসনে যিনি নির্বাচিত হলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আরেকটি নির্বাচন করলে কীভাবে সেটা সম্ভব? আমি মনে করি, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ করা উচিত। একটি পদ শূন্য ঘোষণা করা উচিত, আর তা হলো সংসদ সদস্য পদ। অন্যথায় নির্বাচন হলে, তা হবে অবৈধ নির্বাচন এবং তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
এনটিভি অনলাইন : আগামী নির্বাচনে আপনার দলের প্রস্তুতি কী…
সানাউল্লাহ মিয়া : আমি মনে করি, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে পুরোপুরি প্রস্তুত। প্রতিটি আসনে বিএনপি কমপক্ষে তিনটি করে প্রার্থী দেওয়ার ক্ষমতায় রাখে। বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল মিলে দেশে কোটি নেতাকর্মী আছেন। এত নির্যাতন, হামলা, মামলা, গুম-খুনের পরও বিএনপির কোনো নেতাকর্মী অন্য কোনো দলে যায়নি। বরং অন্য দল থেকে এই দলে নেতাকর্মীরা আসছেন। এটাই বিএনপির সবচেয়ে বড় সফলতা।
এনটিভি অনলাইন : নির্বাচন প্রক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
সানাউল্লাহ মিয়া : আমি মনে করি, জনগণ যে ভোটের অধিকার হারিয়েছে সেটি আগে ফিরিয়ে আনতে হবে। জনগণ যেন স্বাচ্ছন্দ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণ যেন সঠিকভাবে ভোট পারে, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
আমার নেতা জিয়াউর রহমান বলেছেন, জনগণই একমাত্র ক্ষমতার উৎস। সেনাবাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। কেন না পুলিশ-র্যাব ইতিমধ্যে বিতর্কিত হয়ে গেছে। একতরফা কোনো নির্বাচন যেন না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমি প্রত্যাশা করি, সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে।
এনটিভি অনলাইন : আপনি কি প্রার্থী হবেন?
সানাউল্লাহ মিয়া : ১৯৯১ সাল থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনের জন্য আমি চেষ্টা করে আসছি। তবে এবার আমি নরসিংদী-৩ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করব। আমাকে ওই আসনে কাজ করার জন্য নেত্রী বলে দিয়েছেন। সেভাবেই আমি কাজ করে যাচ্ছি। দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান বলেছেন, বেশি করে এলাকায় যাওয়ার জন্য। আমি সেটি অব্যাহত রেখেছি।
এনটিভি অনলাইন : দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরবেন কি না?
সানাউল্লাহ মিয়া : বর্তমান সরকার চায় না তারেক রহমান দেশে ফিরে আসুক। তিনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন। আমি আশাবাদী পরিবেশ অনুকূল হলে তিনি দেশে ফিরে আসবেন। ওনার দেশপ্রেম প্রবল। উনি বিদেশে বসেও সব নেতাকর্মীর খোঁজখবর নিচ্ছেন, দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
এনটিভি অনলাইন : বিএনপির চেয়ারপারসন কবে নাগাদ ফিরে আসতে পারেন?
সানাউল্লাহ মিয়া : ম্যাডাম চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেছেন। তাঁর চিকিৎসা শেষ হলেই দেশে ফিরে আসবেন। ওখান থেকে তিনি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি দেশে ফিরবেন।
এনটিভি অনলাইন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সানাউল্লাহ মিয়া : এনটিভি অনলাইনকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।