‘লইঞ্চা কয় ওইদিকে,একটা মারে কয়েকটা ঘর পুড়ে যায়’
‘বাবারে লইঞ্চা কয় ওইদিকে। একটা মারে। কয়েকটা ঘর পুড়ে যায়।’ নিজের গ্রাম মেরুল্লায় ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞের কথা বলছিলেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা আবদুল রসুল। বয়স ষাটের বেশি। পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজারের শাপলাপুর গ্রামের।
আজ রোববার শাপলাপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় গত এক সপ্তাহে শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজার থেকে টেকনাফগামী সড়কে। সেখানেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশের কা-কীর্তির কথা বলছিলেন আবদুল রসুল।
লইঞ্চা জিনিসটা কী? রসুল জানালেন এক ধরনের বোমা। এটাকে রোহিঙ্গারা এ নামেই চেনে। সেনারা বাড়ি লক্ষ্য করে ওই বোমা মারে। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে আগুন। গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে যায়।
দিনের বেলায় নাকি রাতের বেলায় আগুন দেয়? জানতে চাইলে রসুল জানান, কোনো ঠিক নেই। রাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বেশি। আগুন দিয়ে তো চলে যায় না। আগুন থেকে বাঁচার জন্য ছোটাছুটি করা মানুষদের ওপর গুলি করে। কেবল গুলি করেই তারা ক্ষান্ত হয় না। গলা কেটে নিশ্চিত করে মৃত্যু।
কখন সিদ্ধান্ত নেন গ্রাম ছাড়ার? রসুল জানান, আগুন লাগিয়ে জানান দেয় যে শুরু হলো নির্যাতন। এরপর যুবক, তরুণদের খুঁজবে। এদের আগে মারে। আর অবিবাহিত মেয়ে থাকলে তো কোনো রক্ষা নাই। আগে ধর্ষণ করবে এরপর হত্যা করবে। রসুল আরো জানান, ঘর ছাড়া প্রায় প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সেনাদের হাতে মারা গেছে। আগুনে ঘর গেল, পরে ছেলেমেয়েও গেল। এরপর আর কেউ নিজ গ্রামে থাকতে চায় না। যত জমিই থাকুক, যত গরুই থাকুক। প্রাণ বাঁচানো তখন বড় কাজ।
রসুল জানান, নির্যাতিত রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে প্রথমে আশ্রয় নেয় ‘মূড়া’তে। পাহাড়ি বনকে মূড়া বলেন তাঁরা। সেখানে টানা পাঁচ থেকে ছয়দিন থাকা হয়। হাতে করে আনা শুকনো খাবার ওখানেই আসলে শেষ হয়ে যায়। কারণ খাবারের অন্য কোনো উপায় নেই।
রসুল জানালেন, বনে আশ্রয় নিলেও রক্ষা নেই। বনেও অভিযান চালায় সেনারা। ইচ্ছেমত গুলি করে। অনেক লুকিয়ে থাকা মানুষ তখন মারা যায়।
তখন বনে থাকাও নিরাপদ মনে হয় না। তখনই মনে হয় বাংলাদেশে চলে আসার কথা। রসুল জানালেন, রোহিঙ্গারা তখন নিজেদের শেষ সম্বলের দিকে হাত দেয়। অর্থাৎ জমানো টাকা বা সোনার গয়না বা অন্য মূল্যবান কিছু। দালালদের হাতে তা তুলে দিয়ে নৌকা ধরতে হয়। ওই বন থেকে নৌকা পর্যন্ত আসতে তিনদিন লেগে যায়। পুরোটা পথ হেঁটে আসতে হয়। আবার দিনের আলোতেও হাঁটা যায় না। হেঁটে আসতে হয় রাতে। কারণ ওই হাঁটা পথেও মিয়ানমারের সেনারা অভিযান পরিচালনা করে। আর দেখামাত্রই গুলি করে বা ধরে নিয়ে যায়।
রসুল জানালেন, নৌকায় উঠেও নিরাপদ মনে হয় না। কেবলই কানে ভাসে গুলির শব্দ। আর নৌকা উল্টে যাওয়ার ভয় তো আছেই। নৌকা উল্টে যায় প্রায়ই। আর সাঁতার না জানলে কিছুই করার থাকে না।