‘ওই ওড়নাতেই চলে গেল স্বর্ণা’
ছোট একটা ঘর। বিছানার ওপর ঝুলছে কাপড়ে বানানো একটা টিয়াপাখি। সাদা দেয়ালে রূপকথার রাজকুমারীর ছবি আঁকা। বুদ্ধিমান কার্টুন চরিত্র ডোরেমনও আছে। ফ্যানটা কিছুটা কালচে হয়ে গেছে। বোঝাই যায়, বেশ কয়েকদিন মোছা হয়নি। ওই ফ্যানেই ঝুলে ছিল কিশোরী স্বর্ণার নিথর দেহ!
স্বর্ণার গলায় প্যাঁচানো ছিল ওড়না। স্বর্ণার বাবা সুব্রত বর্মণ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ওর আবদার ছিল এ রকম ওড়নার। আমি সিঙ্গাপুর থেকে এনেছিলাম। ওই ওড়না পেঁচিয়েই ও চলে গেল।’
স্বর্ণার আসল নাম অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা। গত বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডের নিজেদের বাসা থেকে স্বর্ণার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। মেধাবী ছাত্রী স্বর্ণা পড়ত হলিক্রস স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে।
স্বর্ণার বাবা সুব্রত বর্ধন একজন আইনজীবী। তিনি জানান, মেয়ের লাশ উদ্ধারের দিনই শুনতে পান ‘ব্লু হোয়েল’ নামের একটি সোশাল মিডিয়া নির্ভর গেমসের কথা। তিনি দাবি করছেন, ওই গেমসে অংশ নিয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তাঁর মেয়ে।
অভিযোগ উঠেছে ব্লু হোয়েল গেমসটি এতে অংশগ্রহণকারীদের আত্মহত্যা প্রবণ করে তোলে। বিশ্বের একাধিক দেশে এ গেমসে অংশ নেওয়া একাধিক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগও আছে।
স্বর্ণার লেখা ‘সুইসাইড নোটে’ ওই গেমসের একটি চিহ্ন আঁকা ছিল। এ ছাড়া ওর পায়েও এ ধরনের চিহ্ন আঁকা ছিল।
স্বর্ণার ঘরে বসেই মেয়ে সম্পর্কে বলছিলেন সুব্রত। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের মুখে কোনোদিন আমি এই গেমটির নাম শুনি নাই। কিন্তু মারা যাওয়ার দিন আমি এ সম্পর্কে শুনি। বাসায় ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে মনে হয় স্বর্ণা ব্লু হোয়েল গেমসে আসক্ত ছিল। আমার তো কোনো কিছুর অভাব নেই, যখন যেটা চাচ্ছে তখন সেটাই পাচ্ছিল। আমি তাঁর মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখি নাই। কেবল লক্ষ করতাম যে, রাত জেগে সে ফোন ব্যবহার করত। আর কিছু দিন থেকে ও শুধু ছাদে যেতে চাইত।’
সুব্রত বলেন, ‘ছাদে ও একা একা ঘুরত। এমনকি হঠাৎ হঠাৎ করে ওর ছাদে যাওয়ার নেশা উঠত, বলত পাপা কি সুন্দর আকাশে চাঁদ উঠছে চল ছাদে যাই। রাত ১১টার পরে অনেক বার আমি নিজেই তাঁকে ছাদে নিয়ে গেছি। পূর্ণিমার চাঁদ তাঁর খুব পছন্দ ছিল।’
বৃহস্পতিবারের ঘটনা নিয়ে কথা বলেন সুব্রত। তিনি বলেন, ‘স্বর্ণার ঘরের লক লাগানো থাকত না। ওই দিন ভোর ৬টার দিকে ওর মা ঘুম থেকে ওঠার পরে তাঁর রুমের লক লাগানো দেখতে পায়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। পরে সে চাবি দিয়ে দরজা খোলে। এরপর দরজা একটু খানি খুলেই মেয়েকে ফ্যানের সঙ্গে গলায় নাইলনের ওড়নায় পেঁচানো অবস্থায় ঝুলতে দেখে ওর মা। আমি গিয়ে দেখি, খাটের উপর বসানো একটি চেয়ার পড়ে আছে। চেয়ারটি খাটের পশ্চিম পাশে নিচে পড়লেই কাজের মেয়েটি জেগে উঠত। তা যাতে না হয় এবং কোনো শব্দ যাতে না হয় সে জন্য বিছানার ওপর ফেলা হয়েছে চেয়ারটি।’
সুব্রত বলেন, ‘আমি দ্রুত ওড়না কেটে মেয়েকে নিচে নামিয়ে খাটের উপরে শুয়ে দেই। ওর জিহ্বা বের করা ছিল, আর চোখগুলো কেমন ভাবে যেন তাকানো অবস্থায় ছিল। আর এই ওড়না আমি সিঙ্গাপুর থেকে কিনে এনেছিলাম।’
সুব্রত কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার মেয়ে সাজতে অনেক পছন্দ করত। ও একটি ওড়না চেয়েছিল, যা ও সব ড্রেসের সঙ্গে পরতে পারবে। আমি সিঙ্গাপুর থেকে ওই ওড়না এনে দেই। ওই ওড়নাতেই সে চিরতরে চলে যাবে এমন জানলে কখনোই আনতাম না ওই ওড়না।