নির্বাচন কমিশনে যেসব প্রস্তাব দিল বিএনপি
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে ২০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। এগুলোর মধ্যে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের প্রস্তাবও রয়েছে।
ভোটের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন, ২০০৮ সালের আগের সংসদীয় আসন সীমানা ফিরিয়ে আনা, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালু না করার প্রস্তাবও দিয়েছে বিএনপি
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে দায়িত্বে আসা কে এম নুরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও আজ রোববার তাদের সঙ্গে সংলাপে বসে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি।
প্রস্তাবনার সারসংক্ষেপ জানাতে গিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করতে হবে।
প্রস্তাবগুলো হলো :
১. নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার গঠন;
২.০ সকল দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ তৈরীকরণ;
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ তৈরির জন্য উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলো নিম্নরূপ;
২.১ সংসদ ভেঙে দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান;
২.২ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের কার্যকর সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ;
২.৩ রাজনৈতিক দলের নেতা-র্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও কারাবন্দি নেতা-কর্মীদের মুক্তি;
২.৪ এখন থেকেই সকল রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশসহ সব স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অধিকার নিশ্চিতকরণ;
৩.০ প্রশাসন বিষয়ক;
৩.১ প্রশাসনকে অবশ্যই দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে। নির্বাচনের ৬ (ছয়) মাস আগে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল করে স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
৪.০ ভোটগ্রহণে যন্ত্রের ব্যবহার : বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণে কোনোক্রমেই ইভিএম/ডিভিএম পদ্ধতি কিংবা এ জাতীয় কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
৫.০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত : ২০০৮ সালের পূর্বে নির্বাচনী আসনসমূহের যে সীমানা ছিল সেই আসন সীমানা পুনর্বহাল করতে হবে;
৬.০ আরপিওর কিছু সংশোধনী প্রস্তাব;
৬.১ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে মোতায়েনকরণ: নির্বাচনের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে থেকে নির্বাচিত নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনী আসনে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ম্যাজিস্টেরিয়াল ক্ষমতা প্রদানপূর্বক নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত করতে হবে;
৬.২ নির্বাচনী আচরণ বিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তাদেরও ম্যাজিস্টেরিয়াল ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে;
৬.৩ কোনো রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর প্রতীকের স্পষ্টতা বিনষ্ট না করে ব্যালট পেপারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে ব্যালট পেপারে দৃশ্যমান জলছাপ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
৬.৪ রিটার্নিং অফিসার এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। এতে কমিশনের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় হবে;
৬.৫ ভোটকেন্দ্র বাছাই ও নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে খসড়া তালিকা প্রকাশ করতে হবে;
৭.০ নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, ২০০৮ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব: নির্বাচনী মালামাল বিতরণের সময় প্রতি ভোটকেন্দ্রের ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স-এর নম্বর সংবলিত চালানপত্রের ফটোকপি প্রার্থী বা প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টকে প্রদান করতে হবে। এতে পোলিং এজেন্ট এই কপির সাথে কেন্দ্রের ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্সর নম্বর মিলিয়ে যাচাই করে নিতে পারবেন;
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জন্য নির্ধারিত ও সংরক্ষিত প্রতীকের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে কিংবা কোনোক্রমে মিল আছে মর্মে প্রতীয়মান হয় এমন কোনো মার্কা/প্রতীক বরাদ্দ করা যাবে না।
৮.০ রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব: সকল রাজনৈতিক দলের ও প্রার্থীর সভা-সমাবেশ-পথসভা করার ক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে;
৯.০ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশন সংসদের মেয়াদ পূর্তির পূর্ববর্তী ১২ মাসের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ বা দরখাস্ত আহ্বান করতে পারবে না;
১০.০ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা/গাইডলাইন :
সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। এ বিবেচনায় দেশীয় পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনয়ন এবং অধিকসংখ্যক বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আগমন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব নিম্নরূপ :
১০.১ কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মী কিংবা রাজনৈতিক দলের প্রতি প্রকাশ্য আনুগত্য পোষণকারী কোনো ব্যক্তি বা তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো পর্যবেক্ষক সংস্থা কিংবা সংস্থার কোনো ব্যক্তি নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হতে পারবেন না;
১০.২ বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভিসা সহজীকরণের জন্য নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপযুক্ত প্রতিনিধির সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিসের ব্যবস্থা করতে হবে;
১১.০ প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ :
প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকরা ভোটার হতে অত্যন্ত আগ্রহী। বর্তমানে তাঁরা ভোটার হতে পারছেন না। প্রবাসী বাংলাদেশিদের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী এবং জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁদের অবদান বিবেচনায় প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বহু গণতান্ত্রিক দেশে প্রবাসীদের ভোটার হওয়ার সুযোগ আছে। ভোটার তালিকাভুক্ত মৃত ব্যক্তিদের নাম ভোটার তালিকা হতে কর্তন নিশ্চিত করতে হবে। ভোটার হওয়ার যোগ্য কারাবন্দি নাগরিকদের তালিকাভুক্তকরণ;
১২.০ নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলের উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ের কর্মী এবং সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টদের নির্বাচনী আইন ও বিধি-বিধান সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে।
রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী এজেন্ট ও পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ প্রদানে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলসমূহকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দানের জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করবে। রাজনৈতিক দলসমূহ কর্তৃক আয়োজিত এ প্রশিক্ষণে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে নির্বাচন কমিশন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে;
১৩.০ ভোটার সচেতনতামূলক কার্যক্রম :
বিগত কয়েকটি নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন সম্পর্কে ভীতি ও অনীহা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থা বিবেচনায় সাধারণ ভোটারদের ভোটদানে উৎসাহিত করার জন্য Voter awareness program পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৪.০ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন :
১৪. ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি আসনের রিটার্নিং অফিসার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতিনিধি, র্যাবের প্রতিনিধি, আনসার-ভিডিপি অফিসার এবং ক্ষেত্রমত কোস্টগার্ড ও বিজিবির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রতিটি জেলায় ও মেট্রোপলিটন এলাকায় একটি করে কমিটি গঠন করতে হবে। এ কমিটি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে নৈর্ব্যক্তিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করবে;
১৫.০ গণমাধ্যম সংক্রান্ত :
বন্ধঘোষিত সব গণমাধ্যম চালু করতে হবে। নির্বাচনকালীন গণমাধ্যমে সব দল ও প্রার্থীর প্রচারণায় সমতাভিত্তিক সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ আইসিটি অ্যাক্ট-এর বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করতে হবে;
১৬.০ মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক সংক্রান্ত :
১৬.১ নির্বাচনের দিন মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক চালু রাখতে হবে। ইন্টারনেট সেবা অব্যাহত রাখতে হবে এবং কোনোক্রমেই এর Bandwidth কিংবা গতি কমানো বা সীমিত করা যাবে না। এ ছাড়া অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাবে না। নির্বাচন কমিশন এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে এবং এর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে;
১৭.০ ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে;
১৮.০ নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
১৯.০ নির্বাচন ভবনে প্রবেশের জন্য ‘প্রবেশপত্র’ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে;
২০.০ রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবর্গের পরামর্শ/সুপরিশ বাস্তবায়ন :
ইনিমধ্যে নির্বাচন কমিশন সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের সাথে মতবিনিময় সভা করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যসূত্রে জানা যায় যে, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আলোচনায় অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান, নির্বাচনে প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রশাসন নিশ্চিতকরণের স্বপক্ষে তাদের বলিষ্ঠ যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। আমরা সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের এসব পরামর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও অন্যান্য অংশীজনের সহায়ক মতামত/সুপারিশকে সুবিবেচনায় নিতে হবে। কেননা দেশের জনগণ প্রকৃত অর্থেই এই সংলাপ ও আলোচনায় প্রদত্ত পরামর্শ/সুপারিশের কার্যকর বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। রুটিন বা গতানুগতিক নামমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠান এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নয়। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়া এ প্রতিষ্ঠানের পবিত্র দায়িত্ব। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আপনাদের আন্তরিকতা, দক্ষতা, সক্ষমতা ও নির্ভীক পদক্ষেপ সমগ্র জাতি প্রত্যাশা করে।