সংবাদ বিশ্লেষণ
ইলিয়াস মোল্লাহর ক্ষমা চাওয়া উচিত
১৯৬৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী আচরণ সীমা ছাড়িয়ে যায়। মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র) দিয়েছিলেন অবিস্মরণীয় সেই ভাষণ। ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’ এ শিরোনামের ওই ঐতিহাসিক ভাষণ আজও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করে।
পৃথিবীতে মার্টিন লুথারের ওই বক্তব্যের মতো আরো বেশ কয়েকটি ভাষণ সারা জীবন অমর হয়ে থাকবে। এরমধ্যে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণ একটি। স্বাধীকার আন্দোলনের অনেক কথা বলতে গিয়ে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের অধিকার রক্ষার ডাকও দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তা রক্ষার দায়িত্ব বাংলার মানুষের হাতে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের যেন বদনাম না হয়।’
সেই বঙ্গবন্ধুর গোছানো দল আওয়ামী লীগেরই এক সংসদ সদস্য করলেন বর্ণবাদী মন্তব্য। সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ মনে করেন, আফ্রিকার মানুষরা সভ্য নয়। আর তাঁদের সভ্য করতে আফ্রিকায় গেছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী!
মঙ্গলবার সংসদ ভবনের মিডিয়া কক্ষে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ইলিয়াস মোল্লাহ। তিনি ওই কমিটির একজন সদস্য। সম্প্রতি আফ্রিকা মহাদেশের কঙ্গো ও আইভরি কোস্টে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের কাজ দেখে আসা সংসদ সদস্যদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
ইলিয়াস মোল্লাহ বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনী আফ্রিকার কালো মানুষদের সভ্য করার জন্য গেছে এবং আমি মনে করি, তারা সে কাজ করেই আসবে।’
সংবাদ সম্মেলনে আফ্রিকানদের বারবারই ‘কালো কালো’ মানুষ বলে উল্লেখ করছিলেন এ সংসদ সদস্য। তিনি আরো বলেন, ‘ওখানকার (আফ্রিকার) মানুষ এখনো সভ্যতা পায়নি। তারা ১৫ দিন পর পর গোসল করে। গোসল করার সময় সাবান মেখে গায়ে পানি দেয় না। কারণ ওখান থেকে সুগন্ধি বের হয়।’
রাস্তার কোনো জনসমাবেশে এ কথা বলেননি ইলিয়াস মোল্লাহ। কিংবা দলের কোনো কাউন্সিল বা কমিটির অভ্যন্তরীণ বৈঠকেও এ কথা বলেননি তিনি। বলেছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে। দেশের গণমাধ্যমে এসব বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশিত হওয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়নি যে বক্তব্যটি কেবলই ইলিয়াস মোল্লাহর ব্যক্তিগত। এ নিয়ে কমিটির সভাপতিসহ সদস্যরাও কোনো মন্তব্য করেননি। অথচ ওই সময় উপস্থিত ছিলেন, কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী ভুঁইয়া, সংসদ সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান, মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী, মাহবুবুর রহমান ও হোসনে আরা বেগম। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন আফ্রিকায় ইলিয়াস মোল্লাহর সফরসঙ্গী। তবে কি তাঁর বক্তব্যই কমিটির বক্তব্য? যদি তাই হয় তবে আমাদের বদনাম হলো।
জাতীয় সংসদে ইলিয়াস মোল্লাহ এ কথা বললে স্পিকারের মাধ্যমে তা তুলে নেওয়া (এক্সপাঞ্জ) করা যেত। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে করা এ মন্তব্য এখন তুলে নেওয়ার কোনো উপায় নেই, যদি না ইলিয়াস মোল্লাহ এ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করেন। প্রায় ২৪ ঘণ্টা হয়ে গেল। এখনো সংসদ সদস্যের মুখ দিয়ে কিছু বের হলো না। জাতীয় সংসদের একজন সদস্যের কারণে আমাদের বদনাম হলো।
আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব। শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুনাম অনেক। গৃহযুদ্ধ কবলিত আফ্রিকার দেশগুলোতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সেনাবাহিনী দুর্দান্ত কাজ করছে। সেনাবাহিনীর কারণেই এসব দেশের মানুষ বাংলাদেশকে দেখে কৃতজ্ঞতার চোখে। সেই দূর আফ্রিকা মহাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষ রাতে নিরাপদে ঘুমাতে যান। কেননা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দায়িত্ব পালন করেন আমাদের সেনা সদস্যরা।
সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহর বর্ণবাদী মন্তব্যে জাতিসংঘের কাছে আমাদের সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি কী হতে পারে- তা একবার ভেবে দেখেছেন সংসদ সদস্য? এসব মন্তব্য করে আফ্রিকায় সেনাবাহিনীর ভূমিকাকেই বিতর্কিত করে তুলেছেন ইলিয়াস মোল্লাহ। আমাদের বদনাম হলো। জাতীয় সংসদের তো হলোই। এমন বক্তব্যের জন্য ইলিয়াস মোল্লাহর ক্ষমা চাওয়া উচিত।