নানা আয়োজনে দেশের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসী দিবস পালিত
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘২০১৫ উত্তর এজেন্ডা : আদিবাসীদের স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ।’
১৯৯৪ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি পালন করে আসছে বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি আদিবাসী। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ উপকমিশনের কর্মকর্তারা তাদের প্রথম সভায় আদিবাসী দিবস পালনের জন্য ৯ আগস্টকে বেছে নেন। আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার, পরিবেশ উন্নয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সুদৃঢ় করা এবং গণসচেতনতা সৃষ্টি করাই বিশ্ব আদিবাসী দশক, বর্ষ ও দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচির মধ্যে ছিল সমাবেশ, মানববন্ধন, র্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আমাদের প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
আরিচ আহমেদ শাহ, চট্টগ্রাম : সকালে চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে আয়োজিত সমাবেশ উদ্বোধন করেন অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত। আদিবাসী ফোরাম চট্টগ্রামের আহ্বায়ক সরদ জ্যোতি চাকমার সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি ও প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাহমান নাসির উদ্দিন।
সমাবেশে বক্তারা পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নসহ আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত শারীরিক মানসিক নির্যাতন, হয়রানিসহ নারী ধর্ষণের মতো ঘটনার শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন চট্টগ্রাম আদিবাসী ফোরাম। বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশ থেকে সমতলে বসবাসরত আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন দাবি জানানো হয়। সমাবেশের শেষ পর্বে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মারুফ আহমেদ, সিলেট : সকালে বিভাগীয় আদিবাসী দিবস উদযাপন কমিটির উদ্যোগে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আদিবাসী দিবস উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক গৌরাঙ্গ মহাপাত্রর সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন আদিবাসী নেতা কবি এ কে শেরাম, বনিফাস খংলা, উন্নয়ন সংস্থা সুজনের সভাপতি ফারুখ মাহমুদ চৌধুরীসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
র্যালির আগে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি উদযাপন, আদিবাসী উন্নয়ন কাউন্সিল গঠন, সাংস্কৃতিক একাডেমি নির্মাণ, পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করে ভূমির মালিকানা দেওয়াসহ সাতদফা দাবি উপস্থাপন করেন। এরপর সেখানে চা নৃত্য ও খাসিয়া নৃত্য পরিবেশন করেন আদিবাসী শিল্পীরা। সমাবেশে শেষে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
আলাউদ্দিন শাহরিয়ার, বান্দরবান : সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে আজ বেলা ১১টায় বান্দরবানের স্থানীয় রাজবাড়ির মাঠ থেকে আদিবাসী দিবস উদযাপন কমিটির ব্যানারে বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়। র্যালিতে মারমা, চাকমা, ম্রো, বম, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, খুমি, খেয়াংসহ ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ ও তরুণ-তরুণীরা জাতিসত্তার নিজস্ব পোশাকে অংশ নেন। এ ছাড়া দিবসকে ঘিরে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নাচে-গানে মাতিয়ে তুলেন পাহাড়িরা।
এরপর রাজবাড়ির মাঠে একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য ও জেএসএস কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা কে এস মং মারমা। আদিবাসী ফোরামের নেতা জলিমং মারমার সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য রয়েল ডেভিড বম, অনন্যা নারী কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ডনাই প্রু নেলী, সদর উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াইচিং প্রু মারমা, শিক্ষক ও লেখক ক্যশৈ প্রু খোকা, ইউপি চেয়ারম্যান শম্ভু কুমার নাথসহ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নেতারা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে এস মং মারমা বলেছেন, সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের নায্য দাবি। আদিবাসী জাগিগুলোর জীবনধারার উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দেওয়ায় এ অঞ্চলের আদিবাসীরা উন্নয়নের স্রোতধারা থেকে আজও বঞ্চিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সবক্ষেত্রে সমতল ভূমির মানুষগুলোর চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।
জেএসএস কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিকবিষয়ক সম্পাদক জলিমং মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির দীর্ঘ ১৮ বছর অতিবাহিত হলেও চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো আজও বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তি বাস্তবায়নের নামে সরকার তালবাহানা করছে। শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়ার পাহাড়ের প্রধান সমস্যা ভূমি জটিলতা নিরসন সম্ভব নয়। ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন ২০০১-এর সাংঘর্ষিক ধারাগুলোও বাতিল করতে হবে।
ফজলে এলাহী, রাঙামাটি : রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসী দিবস পালন এবং আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে রাঙামাটিতে পালিত হয়েছে বিশ্ব আদিবাসী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সকালে রাঙামাটি শহরের পৌরসভা চত্বরে আলোচনা সভার পর শহরে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাঙামাটির সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার। উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। বক্তব্য দেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অরুণ কান্তি চাকমা, এম এন লারমা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বিজয় কেতন চাকমা, আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল কমিটির আহ্বায়ক প্রকৃত রঞ্জন চাকমা প্রমুখ।
আলোচনা সভায় বক্তারা, বাংলাদেশ সরকার আদিবাসী দিবস পালন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আগামী বছর থেকেই আদিবাসী দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন এবং তাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। পরে একটি র্যালি শহর প্রদক্ষিণ করে রাজবাড়ী এলাকায় অবস্থিত জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে গিয়ে শেষ হয়।
আবু তাহের মুহাম্মদ, খাগড়াছড়ি : আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে র্যালিসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে খাগড়াছড়িতে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে আজ সকালে খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ মারমা সংগঠন ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে পৃথকভাবে বর্ণাঢ্য রালি বের করা হয়। র্যালিতে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন ঐতিহ্যবাহী পোশাকে অংশগ্রহণ করে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট ফোরামের যৌথ উদ্যোগে শহরের মহিলা কলেজ এলাকা থেকে শুরু হওয়া র্যালিটির উদ্বোধন করেন শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা। র্যালিটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার মহিলা কলেজ এলাকায় গিয়ে শেষ হয়। এতে অন্যদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষাবিদ প্রজ্ঞাবির চাকমা, আদিবাসী ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সমন্বয়ক চাইথোআই মারমা, মারমা স্টুডেন্ট ফোরামের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সাচিং মারমা প্রমুখ।
ইকরাম চৌধুরী টিপু, কক্সবাজার : পার্বত্য এলাকায় ভুমি অধিকার ও শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নসহ নানা দাবিতে কক্সবাজারে আদিবাসী দিবস পালিত হয়েছে। দিনটি উপলক্ষে রোববার দুপুরে কক্সবাজার শহীদ মিনারের চত্বর থেকে র্যালি বের হয়। পরে কক্সবাজার পৌরসভা চত্বরে এক মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে আদিবাসী ফোরামের নেতারা বক্তব্য দেন।
সুভাষ চৌধুরী, সাতক্ষীরা : অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবার সহায়তা চেয়ে সাতক্ষীরায় অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্ব আদিবাসী দিবস । সকালে জেলায় বসবাসকারী আদিবাসী নারী পুরুষ সদর উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে একটি র্যালি বের করে। র্যালিটি শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে শহীদ রাজ্জাক পার্কে এক সমাবেশে মিলিত হয়। জেলার আদিবাসী নেতা পরিমল মুণ্ডার সভাপতিত্বে আয়োজিত সমাবেশে বক্তৃতা করেন জেলা পরিষদ প্রশাসক মুনসুর আহমেদ, প্রেসক্লাব সভাপতি অধ্যাপক আবু আহমেদ , সাতক্ষীরা পৌর সভার প্যানেল মেয়র সফিকুদ্দৌলা সাগর, অগ্রগতি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আবদুস সবুর, মহিলা পরিষদ নেত্রী জোসনা দত্ত, অসীম দাস প্রমুখ। সমাবেশ শেষে আদিবাসীদের ১২ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয় ।
দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী, সুনামগঞ্জ : আদিবাসী দিবস উপলক্ষে সুনামগঞ্জের র্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল সাড়ে ১১টায় সদর উপজেলার জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের নারায়ণতলা এলাকায় নারায়ণতলা মিশন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আদিবাসী দিবস উদযাপন কমিটি ও টেংশুয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে র্যালিটি বের হয়ে চৌমুহনী বাজারে গিয়ে বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ শেষে পুনরায় বিদ্যালয়ে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে কয়েক গ্রামের পাঁচ শতাধিক স্থানীয় আদিবাসী নেতা অংশ নেন।
টেংশুয়া ফাউন্ডেশনের সভাপতি পান্না রাণী হাউইয়ের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সানক্রেডের কর্মকর্তা সত্যেন্দ্র নাথ মিত্র, মিশন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফাদার সরোজ কস্তা প্রমুখ। সভায় অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান আদিবাসীরা।