‘রাজনীতি মানেই কি বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ?’
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে হালকা নাস্তা করানো হবে- এ উদ্ধৃতি দিয়ে দেশীয় জঙ্গি সংগঠন আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সহায়তায় হামলা করে। তৎকালীন রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সাহায্যে প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটনাস্থল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩ নম্বর বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সম্মুখে যুদ্ধে ব্যবহৃত স্পেশালাইজড মারণাস্ত্র, আর্জেস, গ্রেনেড বিস্ফোরণের মাধ্যমে ঘটনা ঘটানো হয়। প্রশ্ন ওঠে কেন এই মারণাস্ত্রের ব্যবহার? এটা কাম্য নয়।’
আজ বুধবার রাজধানীর নাজিমুদ্দিন রোডে পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ’১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে হত্যা করার পর চার জাতীয় নেতাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেমে না গিয়ে বহমান থাকে। পরবর্তী ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শনিবার আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হয়। শেখ হাসিনাকে নাশতা করানো হবে। এই উদ্ধৃতি দিয়ে দেশীয় জঙ্গি সংগঠনের কতিপয় সদস্য আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সহায়তায় হামলা করে।’
‘রাজনীতি মানেই কি বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ? শুধু নেতৃত্ব নয় দলকে নেতৃত্ব শূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা। রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধীদলকে নেতৃত্ব শূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে?’ এটা কাম্য নয় বলে পর্যবেক্ষণে বলেছেন আদালত।
‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতায় যে দলই থাকবে, বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেও গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়।’
ঘটনার সময় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ফলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর ডান কানে গুরুতর জখম হয়। আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে উল্লেখিত নৃশংস ও ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব বলে আদালত মনে করেন।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামিদের আজ বুধবার আদালতে নেওয়া হয়। ছবি : ফোকাস বাংলা
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ‘সাধারণ জনগন এ রাজনীতি চায় না। সাধারণ জনগণ চায় যে কোনো রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে যোগ দিয়ে সে দলের নীতি, আদর্শ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানধারণ করতে পারবে। আর সেই সভা-সমাবেশে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ জনগণকে হত্যার ধারা চালু থাকলে পরবর্তীতে দেশের সাধারণ জনগণ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়বে। আদালত চায় না সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর দরগাহ শরিফের ঘটনার, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ওপর নৃশংস হামলার, রমনা বটমূলে সংঘটিত বোমা হামলার এবং অত্র মোকদ্দমায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ওপর নৃশংস বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার পুনারাবৃত্তি।’
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় আজ সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। ৪৯ আসামির মধ্যে বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
ফাঁসির আসামির মধ্যে আরো রয়েছেন সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, ডিজিএফআইর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তখনকার মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, মাইন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মাইন ওরফে খাজা ওরফে আবু জানদাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ প্রমুখ।
যাবজ্জীবনপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী প্রমুখ। খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে দলটির সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই নৃশংস হামলায় ২৪ জন নিহত ও নেতাকর্মী-আইনজীবী-সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক লোক আহত হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানও।
তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য নেতা এই গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যান। এতে অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তাঁর শ্রবণশক্তি আঘাতপ্রাপ্ত হয়।