পাঁচ কারণে ফেইক নিউজ, বললেন আইনমন্ত্রী
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ফেইক নিউজ বা ভুয়া খবর প্রচার ও প্রকাশ বন্ধের জন্য সরকারের একার পক্ষে সফলভাবে কাজ করা সম্ভব নয়।’ এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে জানান তিনি।
আজ শনিবার সকালে রাজধানীর কসমস সেন্টারে অনুষ্ঠিত ‘ভুয়া খবর ও ঘৃণামূলক বক্তব্য, কারণ ও পরিণাম : কীভাবে তা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন আনিসুল হক।
বাংলাদেশি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কসমস গ্রুপের জনকল্যাণমূলক সংস্থা কসমস ফাউন্ডেশন এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
এ সময় ফেইক নিউজ বা ভুয়া খবর বাংলাদেশে নতুন কোনো ধারণা নয় উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘ফেইক নিউজের প্রভাবে সমাজে সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে।’ খবর ও ভুয়া খবর অনেকটা সত্য ও মিথ্যার মতোই সমান্তরালভাবে যুগ যুগ ধরে প্রচার ও প্রকাশ হয়ে আসছে বলেও জানান মন্ত্রী।
মন্ত্রী আনিসুল হক আরো বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী অনেক ভুয়া খবর ছড়িয়েছিল। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য দেশে ও বিদেশে অনেক ভুয়া খবর ছড়ানো হয়েছে।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রধানত পাঁচটি উদ্দেশে ফেইক নিউজ চর্চা করা হয়। এগুলো হচ্ছে- সাম্প্রদায়িক গুজব ছড়ানো, উগ্র রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মিথ্যাচার প্রচার, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং অবৈজ্ঞানিক জল্পনা-কল্পনা প্রচার করা।’
ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ভুয়া খবর প্রচারের বড় প্ল্যাটফর্ম উল্লেখ করে আনিসুল হক বলেন, ‘বিপদের কারণ হলো, এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য খুব দ্রুতগতিতে সংবাদমাধ্যমগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলো, যাদের অধিকাংশই তথ্যের সত্য-মিথ্যা খতিয়ে দেখে না। তাদের দ্বারা যেকোনো চাঞ্চল্যকর ভুয়া খবর মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে।’
আনিসুল হক আরো বলেন, এখন বাংলাদেশসহ অনেক দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো সংবাদের প্রাথমিক উৎস হিসেবে ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে থাকে। তবে, কাজটা দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে করলে ঝুঁকির আশঙ্কা কম থাকে।
ভুয়া খবর প্রতিরোধে সরকার কাজ করছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘ফেইক নিউজের প্রচার ও প্রকাশ বন্ধে সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রণয়ন, সাইবার আদালত গঠন এবং গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ সেল গঠন করেছে। এর পাশাপাশি অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য রেজিস্ট্রেশনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং অনলাইন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করছে।’ এ ছাড়া ফেইক নিউজের প্রচার ও প্রকাশ বন্ধে বিটিআরসি, আইসিটি বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কাজ করছে বলে জানান আইনমন্ত্রী।
আনিসুল হক আরো বলেন, ‘সরকারের একার পক্ষে এ কাজ সফলভাবে করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তৈরি এবং দ্রুততম সময়ে সেগুলো পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যাতে মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার দারস্থ না হয়।’
সংবাদমাধ্যমগুলোকে সত্য এড়ানোর প্রবণতা বা নীরবতা থেকে বেড়িয়ে আসার তাগিদ দিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের সত্য জানার পথ যেখানে বন্ধ হয়ে যায়, ফেইক নিউজের পথচলা সেখান থেকেই শুরু হয়। যে সংবাদমাধ্যমের বা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হুবহু নকল হবে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তাদেরকেই নিতে হবে। সাইট নকলের ক্ষেত্রে যেকোনো প্রতিষ্ঠিত হাউজের আইনি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা উচিত।’
‘ফেইক নিউজ চিহ্নিতকরণের জন্য এর মধ্যে ভারতে অল্টনিউজ নামে একটি সফটওয়্যার উদ্ভাবন করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে’ এমন তথ্য জানিয়ে মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘ফেইক নিউজ চিহ্নিতকরণের জন্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা উচিত। কারণ, প্রযুক্তিকে প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবিলা করা সমীচীন।’
আনিসুল হক বলেন, সোশ্যাল মিডিয়াগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে এবং যারা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ফেইক নিউজ তৈরি করে, তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের অর্থের উৎস খুঁজে বের করতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে জানিয়ে আইনমন্ত্রী আরো বলেন, ‘কোনটা নিউজ আর কোনটা ফেইক নিউজ সে সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখতে হবে। ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা যে লিঙ্ক বা সংবাদ শেয়ার করছি, তা শেয়ার করার আগে অন্তত কয়েকবার চিন্তা করে দেখতে হবে। কারণ, অসচেতনভাবে হলেও একটি ফেইক নিউজ শেয়ার করার কারণে যেকোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আজ আপনি সজ্ঞানে ফেইক নিউজ শেয়ার করলে, আগামীকাল যে নিজেই এর শিকার হবেন না, তা বলা যাবে না। এজন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু দেখেই গুজব ছড়ানো যাবে না।’ ধৈর্য ধরে তথ্য নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করারও আহ্বান জানান আনিসুল হক।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের (আইএসএএস) প্রিন্সিপাল রিসার্চ ফেলো ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান।
অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যান্ড ইন্টারনেট ডেমোক্রেসির (এএআইডি) সভাপতি, ইউরোপ ও আইটি আইন বিশেষজ্ঞ ড্যান শেফেট অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।