আমরা এক হলে বদলে যাবে লাখো জীবন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ নীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করে এখানে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও লভ্যাংশ ভাগাভাগির অংশীদার হতে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এরই মধ্যে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তর হয়েছি এবং আমরা ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি ডিজিটালাইজড জ্ঞানভিত্তিক মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে চলেছি। এ জন্য আমাদের এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
‘বাংলাদেশ এই অর্জন নিশ্চিত করবে। আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে পারলে আমাদের লাখ লাখ লোকের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে পারব।’ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
আজ নেদাল্যান্ডসের হেগে স্থানীয় গ্রান্ড হোটেল আমারাথ কুরহাউসে অনুষ্ঠিত ‘পরিবর্তিত বাংলাদেশ : অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য অংশীদার’ শীর্ষক এক ব্যবসায়িক সম্মেলনে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
সেমিনারে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম, সাবেক ডাচ কৃষিমন্ত্রী ড. সিস ভিরম্যান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশে নিযুক্ত ডাচ রাষ্ট্রদূত লিওনি চুয়েলিনারে এবং ডাচ ব্যবসায়ী নেতা মার্টিন ভারব্রুজেন বক্তব্য দেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা বাসস।
সেমিনারে বাংলাদেশ বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের নেতা এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সাইফুল ইসলাম মহিউদ্দিন ‘বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে অংশীদারত্বের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হেদায়েত উল্লাহ আল মামুন সমাপনী বক্তব্য দেন। সেমিনারে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী নেতা এবং বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ বস্ত্র, লেদার, পাট, সিরামিক, পেট্রো-কেমিকেল, ফার্মাসিউটিক্যাল, শিপ বিল্ডিং, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, প্লাস্টিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল এবং ইলেকট্রনিক, টেলিকমিউনিকেশন এবং আইটি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পানি এবং মেরিন ও অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্প, হাইটেক ম্যানুফেকচারিং ও মাইক্রো প্রসেসরের মতো প্রকৌশল সেক্টরে বিনিয়োগ করায় ডাচ কোম্পানিগুলোকে ধন্যবাদ জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি উদার বিনিয়োগ নীতির দেশ। আইন করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা প্রদান, ট্যাক্স হলিডে, যন্ত্রপাতি আমদানিতে কর রেয়াত, রয়্যালিটির রেমিটেন্স, এক্সিট পলিসি, লভ্যাংশ ও পুঁজি ফিরিয়ে দেশে নিয়ে যাওয়ার সুবিধাসহ অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
‘অন্য আরো সুযোগ-সুবিধার মধ্যে রয়েছে তরুণ, পরিশ্রমী এবং তুলনামূলক স্বল্প বেতনে প্রশিক্ষিত জনশক্তি, স্বল্প খরচে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, ইইউ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, জাপান ও নিউজিল্যান্ডের বাজারে পণ্যের ডিউটি ফ্রি ও কোটা ফ্রি প্রবেশ সুবিধা।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে এবং দেশটি এখন বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এই শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই নারী। এদের বেশির ভাগই দরিদ্র পরিবারের লোক। তাদের কর্মসংস্থান নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতে অগ্রগতির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্য এই খাতে শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, বেতন ও কাজের পরিবেশ উন্নয়নসহ বিভিন্ন সংস্কার করেছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টায় নেদারল্যান্ডসের সরকার ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করছি।
তৈরি পোশাক খাতের মতো দেশে অন্যান্য খাতেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৭ শতাংশ পূরণ করার পর আমরা আমাদের উৎপাদিত ওষুধ বিশ্বের ৮৩টি দেশে রপ্তানি করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের আইসিটি এবং আইসিটি সংশ্লিষ্ট শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সফটওয়্যার ও আইটি সার্ভিসের জন্য বিশ্বের ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশের সফটওয়্যার এখন আইফোন, স্যামসাং গ্যালাক্সি এবং ব্লাকবেরি ফোনে ব্যবহৃত হচ্ছে। গতবছর আমাদের আইটি কোম্পানিগুলো এবং ফ্রিল্যান্স আইটি প্রফেশনালরা ৩৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। প্রতি বছরে প্রায় ২০ হাজার আইটি গ্র্যাজুয়েট এই সেক্টরে যোগ দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে আর একটি দ্রুত অগ্রসরমান শিল্প শিপ বিল্ডিং। আমাদের নির্মাতারা বিশ্বমানের হালকা ও মাঝারি সামুদ্রিক জাহাজ নির্মাণ করে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এই শিল্প এখন ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক বাজারে এক শতাংশ শেয়ার করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য আটটি পূর্ণাঙ্গ রপ্তানি প্রক্রিয়া জোন রয়েছে। সরকার এখন দেশে বিভিন্ন এলাকায় ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা করছে। আমরা আইটি শিল্পের জন্য বাংলাদেশে একাধিক হাইটেক পার্ক করছি। আমরা এই জোনগুলোতে বিনিয়োগ করতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ সুবিধা ঘোষণা করেছি। এসব জোন ও পার্কে যে কেউ ডেভেলপার ও অপারেটর হিসেবে আসতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশ নেদারল্যান্ডস। ১৯৭২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এই দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এরপর থেকে দেশটি বাংলাদেশের বিশ্বস্থ উন্নয়ন ও বাণিজ্য অংশীদার। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে সফর বিনিময়ের মাধ্যমে আমাদের এই দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন উচ্চমাত্রায় পৌঁছেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে এখন নেদারল্যান্ডসের ৬৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। প্রায় ৩০টি ডাচ কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করছে।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক খাতে তাঁর সরকারের বিভিন্ন সাফল্য তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন, লিঙ্গ বৈষম্য, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি, মানবাধিকারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সেমিনারে গৃহায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন।