নুসরাত হত্যা : অধ্যক্ষ সিরাজের গা শিউরে ওঠা জবানবন্দি
ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যায় নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর এই মামলার প্রধান আসামি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা। তিনি স্বীকার করেন, কারাগার থেকে তিনি নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আলোচিত এই হত্যা মামলার রায় হতে যাচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেছে নুসরাতের পরিবার। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আজ ফেনীর আদালতপাড়ায় নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা।
সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের চরকৃষ্ণজয় গ্রামের করিম উল্যাহ সওদাগর বাড়ির মৃত কলিম উল্যাহর ছেলে সিরাজ-উদ-দৌলা। বাবা ছিলেন চা দোকানি। দারিদ্র্যতার মধ্যেই সিরাজ-উদ-দৌলা কামিল পাস করেন। এরপর ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের দৌলতপুর সালামতিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন।
ছয় বছর চাকরি করার পর এক ছাত্রকে যৌন হয়রানি ও দুর্নীতির দায়ে সেখান থেকে চাকরিচ্যুত হন। পরে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রঙমালা মাদ্রাসায় চাকরি নেন। সেখানেও আরেক ছাত্রকে যৌন হয়রানি করে চাকরিচ্যুত হন সিরাজ। পরে ২০০০ সালের ১ জুন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসায় উপাধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। অভিযোগ রয়েছে, এখানে চাকরিতে যোগদানের সময় সিরাজ অভিজ্ঞতার জাল সনদ দিয়েছিলেন।
সিরাজ-উদ-দৌলা রাজিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে একসময়ে তিনি জামায়াতের রোকন ছিলেন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ২০১৬ সালে জামায়াত থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করে মাদ্রাসায় নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করলেও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো আওয়ামী লীগে যোগদান করেননি।
স্থানীয় ১১০ জন বিত্তশালীকে নিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা উম্মুল ক্বোরা নামের একটি ফাউন্ডেশন করেন। এই ফাউন্ডেশনের নামে জমি কেনাবেচার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। আবদুল কাইয়ুম নিশান নামের একজন শেয়ারহোল্ডার সিরাজের বিরুদ্ধে এক কোটি ৩৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের করেন। এই মামলাটি এখনো বিচারাধীন। এ ছাড়া সিরাজের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় একটি নাশকতার মামলাসহ তিনটি মামলা রয়েছে।
পারিবারিক জীবনে পাঁচ ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সিরাজ সবার বড়। ফেনী শহরে তাঁর একটি দোতলা বাড়ি রয়েছে। বাকি ভাইয়েরা সবাই দিনমজুর, দরিদ্র। সিরাজের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলেকে ডাক্তারি পড়াচ্ছেন। নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে গত ২৭ মার্চ তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে নুসরাত হত্যা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাঁর নির্দেশেই এই হত্যার ঘটনা ঘটে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে পুলিশ।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে অধ্যক্ষ সিরাজ নিজের আমলনামা তুলে ধরে বলেন, ‘আমি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিলিয়া মাদ্রাসায় ২০০০ সালে উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করি। পরে ২০০১ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করি। সেই থেকে দীর্ঘ ১৯ বছর দায়িত্ব পালন করি। মাদ্রাসায় দায়িত্ব পালন করার লক্ষ্যে আমি আমার প্রভাব বিস্তার করার জন্য স্থানীয় ক্ষমতাসীন নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি, থানা ও প্রশাসনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলি। ছাত্র ও ছাত্রীদের মধ্যে আমার প্রভাববলয় তৈরি করি। এভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন ভাই, কাউন্সিল মাকসুদের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক হয়। তাঁদের নিয়ে আমি মাদ্রাসার যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতাম ও তা বাস্তবায়ন করতাম।’
‘এভাবে স্থানীয় পর্যায়ে আমার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে আমি কিছু ছাত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলি। তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন, ছাত্রদলের সভাপতি নূর উদ্দিনসহ হাফেজ আবদুল কাদের। এ ছাড়া জাবেদ, জুবায়ের, এমরান, রানা, শামীম, শরীফদের আমি বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করতাম। তাদের পরীক্ষার ফি, বেতন মওকুফ করতাম। তাদের পরীক্ষায় বিশেষ সুবিধা দেওয়া ও তাদের পছন্দের ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করে সেখান থেকে তাদের কমিশন দিতাম।’
সিরাজ আরো বলেন, ‘শাহাদাত হোসেন শামীম ও নূর উদ্দিন আমার খুবই ঘনিষ্ঠ ছাত্র। তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয়েও আলাপ করতাম। মাদ্রাসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ সংক্রান্ত যেকোনো বিষয় তাদের বললে তারা তা করত। তারা পরীক্ষার সময় ছাত্রছাত্রী ভর্তি থেকে শুরু করে পরীক্ষার ফিস রেজিস্ট্রেশন ও ফরম পূরণসহ কাজের ভালো ভাগ পেত। তারা শুধু সরকারি ফি জমা করে বাকি টাকা ভাগ করে নিত। এ ছাড়া কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গেও আমার ভালো সম্পর্ক হয়। কামরুন নাহার মনিকে আমি চেষ্টা করে বিবাহ দিই ও সহযোগিতা করি। তার সঙ্গেও আমার ভালো সম্পর্ক হয়। গত তিন মাস আগে আমার অপর ছাত্রী ফূর্তি (নুসরাতের সহপাঠী) আমার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছিল। আমি তা রুহুল আমিন ভাই ও মাকসুদের মাধ্যমে তার বাবাকে ডেকে সমাধান করি। আমি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকেও এ বিষয়ে তাদের দ্বারা প্রভাবিত করে সমাধান করি।’
নুসরাতের প্রসঙ্গ টেনে সিরাজ জবানবন্দিতে বলেন, ‘তারপর গত ২৭ মার্চ সকালে আমি মাদ্রাসার পিয়ন নুরুল আমিনের মাধ্যমে নুসরাতকে ডাকি। আমি শুধু তাকে একা কক্ষে ঢুকতে দিই। বাকি তিনজন ছাত্রী রুমের বাইরে ছিল। আমার কক্ষে আসার পরে কিছু কথা হয়। তারপর নুসরাত পড়ে যায়। আমি পেছন থেকে তার কোমরে দুই হাত দিই। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। সে সেখানে বসে থাকে। তারপর নুরুল আমিনকে ডাকি। নুসরাত তার বান্ধবীর সঙ্গে চলে যায়। তারপর দুপুরে নুসরাতের মা, ছোট ভাই, কমিশনার ইয়াসিন ও মামুনসহ কয়েকজন আসে।’
সিরাজ আরো বলেন, ‘নুসরাতের মা আমাকে মারার চেষ্টা করেন। আমি একপর্যায়ে তাদের হুমকি দিই। সেখানে নূর উদ্দিন উপস্থিত ছিল। পরে শাহাদাত ও শামীম আসে। আমি অবস্থা বেগতিক দেখে রুহুল আমিন ভাইকে ফোন করি। রুহুল আমিন থানা থেকে উপপরিদর্শক (এসআই) ইকবালকে পাঠায়। তারপর উপপরিদর্শক (এসআই) ইকবাল নুসরাত জাহান রাফিকে ডেকে আনার জন্য বলে। রাফি এলে উপপরিদর্শক (এসআই) ইকবাল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারপরে আমাকেসহ থানায় নিয়ে যায়। সেখানে পরে মামলা রেকর্ড করে। আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
‘২৮ মার্চ আমার অনুরোধে ও কাউন্সিলর মাকসুদ এবং রুহুল আমিনের এর তত্ত্বাবধানে মানববন্ধন করা হয়। মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, আবদুল কাদেরসহ অন্যরা জোর করে নিয়ে আসে। আমাকে ওই দিন আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়। ২৯ মার্চ আমার স্ত্রী ফেরদৌস আরা, ছেলে আদনান প্রথম জেলখানায় দেখা করে। তাদের সঙ্গে কথা হয়। তারপর আমার স্ত্রী, শাশুড়ি, তিন বোন দেখা করে। এ ছাড়া জেলখানায় ছাত্রদের মধ্যে আমার ভক্ত একটি গ্রুপ দেখা করে। তাদের মধ্যে শাহাদাত হোসেন শামীম, নূর উদ্দিন, জাবেদ, রানা ও হাফেজ আবদুল কাদের ছিল। তাদের সঙ্গে মামলা ও জামিন নিয়ে কথা হয়। এ ছাড়া নুসরাত জাহান রাফিদের পরিবারকে আপস করতে বাধ্য করা ও মামলা প্রত্যাহার করার জন্য কী করছে, তা আলাপ করি। তাদের মানববন্ধন ও আমার মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে বলি। তাদের আমি বকাবকি করি। তাদের দ্রুত চিন্তাভাবনা করে আমাকে জানাতে বলি। এ ছাড়া রুহুল আমিন ভাই ও মাকসুদ কাউন্সিলরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার জন্য বলি।’
জবানবন্দিতে সিরাজ বলেন, ‘মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন), আরবি প্রভাষক মাওলানা আবুল কাশেম, সহকারী শিক্ষক বেলায়েত হোসেন, সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন ওরফে সেলিম, সহকারী শিক্ষক হাসান আহম্মদ, অফিস সহকারী সিরাজুল হক দেখা করে। তাদের সঙ্গে মাদ্রাসার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি। গত ৩ এপ্রিল আবার শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, হাফেজ, আবদুল কাদের, জাবেদ, এমরান, রানাসহ কয়েকজন আমার সঙ্গে দেখা করে। ওই সময় জেলখানায় একজন জেলপ্রহরী কিছু দূরে দাঁড়ানো ছিল। আমি তার নাম জানি না। আমরা কিছুক্ষণ কথা বলি। তাদের আমার জামিন মানববন্ধন ও আন্দোলন নিয়ে শুক্রবার জিজ্ঞাসাবাদ করি। তারা জানায়, জামিন এত তাড়াতাড়ি হবে না। পরে নুসরাত জাহান রাফি ও তার পরিবারের বিষয়ে তারা কী করল, তা জানার চেষ্টা করি। এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি প্রকাশ্যে শাহাদাত হোসেন শামীম ও নূর উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলি। অন্যরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল।’
‘তাদেরকে জানাই যে সর্বশক্তি দিয়ে বিষয়টি দেখতে। নুসরাত জাহান রাফির পরিবার ও নুসরাতকে ভালোভাবে চাপ দিতে। যদি এতে কাজ না হয়, তাহলে ভালোভাবে পরিকল্পনা করে নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যা করার জন্য। বিশেষ কায়দায় তাঁকে হত্যা করতে যেন তা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। যদি তারা ভালো মনে করে প্রয়োজনে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার জন্য বলি।’
অধ্যক্ষ আরো বলেন, ‘তাদেরকে আরো বলি যে, এই বিষয়ে রুহুল আমিন ভাই ও মাকসুদ কাউন্সিলর তাদের যেকোনো সহযোগিতা করবে। টাকা-পয়সার প্রয়োজন হলে তাদের মাধ্যমে পাওয়া যাবে। এ ছাড়া থানা ও প্রশাসন তারা ম্যানেজ করবে। খুব ভালোভাবে যাতে পরিকল্পনা করে। এরপরে শাহাদাত হোসেন শামীম ও নূর উদ্দিন আমার কথার সঙ্গে একমত প্রকাশ করে। তারপর তারা চলে যায়।’
সিরাজ আরো বলেন, ‘এরপরে কীভাবে এ হত্যাকাণ্ড করে, তার বিস্তারিত জানতে পারিনি। আমি ভুল করেছি। তাদের এভাবে হুকুম দেওয়া ঠিক হয়নি। আমি অনুতপ্ত।’
এ বছরের ২৭ মার্চ নুসরাতের শ্লীলতাহানির মামলায় পুলিশ সিরাজকে গ্রেপ্তার করে। গত ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। এরপর এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে ৯ এপ্রিল সিরাজকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ১০ এপ্রিল তাঁকে আদালতে তুলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান। আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপরে সিরাজ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।