হত্যা ও গণহত্যার অপরাধ সাকা চৌধুরীর
মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হলো আজ শনিবার। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হত্যা ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হলো তাকে।
২০১২ সালের ৪ এপ্রিল যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইবুন্যাল-১ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১’ ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর প্রথম রায় ঘোষণা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি প্রমাণিত হয়, যার মধ্যে চারটি অভিযোগের বিপরীতে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
এর আগে সাকা চৌধুরী ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হন। তাঁকে একই সালের জুন মাসের একটি গাড়ি ভাঙচুর মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধে জেলহাজতে প্রেরণ করেন।
সাকা চৌধুরীর পক্ষে প্রথমে এক হাজার ১৫৩ জন সাফাই সাক্ষীর নাম দেওয়া হলেও পরে ট্রাইব্যুনাল পাঁচজনের সাক্ষ্যের অনুমতি দেন।
যে চারটি অভিযোগে হত্যা ও গণহত্যায় ফাঁসি হয়েছে তা হলো ৩ নম্বর অভিযোগে গহিরা শ্রী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যা, ৫ নম্বর অভিযোগে সুলতানপুরে শ্রী নেপাল চন্দ্র ও তিনজনকে হত্যা, ৬ নম্বর অভিযোগে ঊনসত্তরপাড়ায় ৬৯-৭০ জনকে গণহত্যা এবং ৮ নম্বর অভিযোগে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহমদ ও তাঁর ছেলে আলমগীরকে হত্যার দায়ে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে অপহরণ ও নির্যাতনের দায়ে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। আর ২, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার মতো অপরাধে জড়িত থাকা এবং এর পরিকল্পনা করার দায়ে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ডের মধ্যে আপিল বিভাগ ৭ নম্বর অভিযোগে ২০ বছরের কারাদণ্ড বাতিল করে খালাস দেন সাকা চৌধুরীকে। এতে তাঁর কারাদণ্ডের মেয়াদ কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ বছর।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর এ দুজনের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর নিয়ম অনুযায়ী ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে হয়। সে অনুযায়ী সময় শেষ হয়ে যাওয়ার একদিন আগেই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেন সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ।
১৮ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মুজাহিদের রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে তাঁদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে রায় দেন আপিল বিভাগ।
২১ নভেম্বর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, সাকা চৌধুরীর প্রাণভিক্ষার আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে যায়। পরে রাষ্ট্রপতি তা নাকচ করে দেন। এরপরই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে যত প্রমাণিত অভিযোগ
২ নম্বর অভিযোগ : প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনা ২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৬টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রামের রাউজানের গহিরা গ্রামে হিন্দু অধ্যুষিত পাড়ায় অভিযান চালিয়ে ওই এলাকার শতাধিক ব্যক্তিকে হিন্দু চিকিৎসক মাখন লাল শর্মার বাড়িতে জড়ো করেন। সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেখানে তাঁদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
৩ নম্বর অভিযোগ : প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনা ৩ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাউজানের গহিরা শ্রী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। সাকা চৌধুরী এ সময় নিজে নূতন চন্দ্র সিংহকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
৪ নম্বর অভিযোগ : ৪ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত জগৎমল্লপাড়ায় অভিযান চালান। এ সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দুই সহযোগীর ডাকে সেখানকার হিন্দুরা কিরণ বিকাশ চৌধুরীর বাড়ির আঙিনায় জড়ো হয়। সেখানে সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে ৩২ জন নারী-পুরুষ মারা যান। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
৫ নম্বর অভিযোগ : প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনা পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল দুপুর ১টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার অনুসারীদের নিয়ে চট্টগ্রাম জেলার রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে হামলা চালান। সেনাসদস্যরা বণিকপাড়ায় প্রবেশ করে ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে অভিযান চালিয়ে নেপাল চন্দ্র ধর, মনীন্দ্র লাল ধর, উপেন্দ্র লাল ধর ও অনিল বরণ ধরকে গুলি করে। এতে প্রথম তিনজন শহীদ ও শেষের জন আহত হন। হত্যাকাণ্ড শেষে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তাঁর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী তাঁদের অনুসারী ও পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে সুলতানপুর গ্রাম ত্যাগ করেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
৬ নম্বর অভিযোগ : এ অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিকেল ৪টায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ক্ষীতিশ মহাজনের বাড়ির পেছনে পুকুরপাড়ে শান্তি মিটিংয়ের নামে হিন্দু নর-নারীদের একত্রিত করে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
৮ নম্বর অভিযোগ : এ অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তাঁর ছেলে শেখ আলমগীরসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্য প্রাইভেটকারযোগে চট্টগ্রামের রাউজান থেকে চট্টগ্রামে শহরে আসছিলেন। পথে হাটহাজারী থানার খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি তিন রাস্তার মোড়ে পৌঁছামাত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা শেখ মোজাফফর আহম্মেদ ও তাঁর ছেলে শেখ আলমগীরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে স্থানীয় পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাঁদের আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
১৭ নম্বর অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম জেলার কোতোয়ালি থানার হাজারী লেনের জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পোড়োবাড়ী থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গুডস হিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দেড় ঘণ্টা তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়। পরে ওই দিন রাত ১১-১২টার দিকে নিজাম উদ্দিন ও সিরাজকে চট্টগ্রাম কারাগারে নিয়ে গিয়ে কারারুদ্ধ করা হয়। সেখানে তাঁরা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত বন্দি ছিলেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
১৮ নম্বর অভিযোগ : ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তৃতীয় সপ্তাহে একদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা চট্টগ্রাম জেলার চান্দগাঁও থানার মোহারা গ্রামে আবদুল মোতালেব চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে তাঁরা সালেহ উদ্দিনকে অপহরণ করেন। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে তাঁকে গুডস হিল নির্যাতন সেলে নেওয়া হয়। সেখানে বাড়ির বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে থাকা সাকা চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং ছোট ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় সালেহ উদ্দিনকে উদ্দেশ করে ফজলুল কাদের চৌধুরী জানতে চান, তিনি সালেহ উদ্দিন কি না? এ সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে সালেহ উদ্দিনের বাঁ গালে সজোরে একটি চড় মারেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।