কামারুজ্জামানের রিভিউ শুনানি ১ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) আবেদনের শুনানি ১ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করেছেন আপিল বিভাগ। আসামিপক্ষের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ এই দিন ধার্য করেন। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
আজ সোমবার সকাল ৯টা ৫ মিনিটে শুরু হওয়া দিন নির্ধারণের এ শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবী ওয়াহেদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের অ্যাডভোকেট-অন-রেকর্ড জয়নুল আবেদীনের পক্ষে আমি এসেছি। এ মামলায় আমাদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে শুনানিতে অংশ নিতে পারছেন না। তাই আমাদের চার সপ্তাহ সময় প্রয়োজন।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের বেঞ্চ বলেন, ‘এ মামলায় দ্রুত বিচারের নিয়ম রয়েছে। সংসদ এ বিষয়ে সচেতন। এ মামলা মুলতবি করার নিয়ম নেই।’
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আসামিপক্ষে খন্দকার মাহবুব হোসেন ছাড়াও আরো জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা রয়েছেন। তাঁরা এ মামলায় শুনানি করতে পারেন।’ এ পর্যায়ে আপিল বেঞ্চ বলেন, এ মামলায় আসামিপক্ষের আবেদনে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে শুধু খন্দকার মাহবুব হোসেনের নাম রয়েছে। আর কোনো জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর নাম নেই। আদালত আসামিপক্ষের সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ১ এপ্রিল শুনানির দিন নির্ধারণ করেন।
পরে বেলা সোয়া ১১টার দিকে নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদনের শুনানি আজ শুরু হবে, গতকাল (রোববার) চেম্বার আদালত থেকে এমন আভাস পেয়েই আমি এসেছিলাম। কিন্তু আসামিপক্ষ চার সপ্তাহের সময় আবেদন করলে আদালত এ মামলার শুনানি ১ এপ্রিল মুলতবি করেন।’
খন্দকার মাহবুব হোসেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণ দেখিয়ে আপিল বিভাগে সময় আবেদন করেন। আদালত তাঁর আবেদনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ দিন ধার্য করেন।
এ ব্যাপারে মাহবুবে আলম বলেন, ‘আদালত জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় নেন। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আপিল বিভাগ সব সময়ই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। আমরা আশা করি, এ মামলাসহ সব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।’
অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ মার্চ বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তাঁর আদেশে শুনানির দিন নির্ধারণ করতে গতকাল রোববার তারিখ ধার্য করেন। তিনি আজ সোমবার শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।
মোট ৭০৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বাতিল ও তাঁর খালাস চেয়েছেন আইনজীবীরা।
গত বছরের ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
এর পর ১৯ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ তিন বিচারপতি কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই বিচারপতি হলেন মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম। পরে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মুস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আইজিপি (প্রিজন) বরাবর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠান। কারাগারে কামারুজ্জামানকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়।
২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। একই বছরের ৬ জুন সাজা বাতিল করে খালাস চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেন কামারুজ্জামান। তবে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো আপিল করেনি। আসামিপক্ষে শুনানির বিপরীতে বক্তব্য পেশ করে রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে ১, ২, ৩, ৪ ও ৭—এই পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ সোহাগপুরের ‘বিধবাপল্লী’-তে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও গোলাম মোস্তফা হত্যাকাণ্ডের দায়ে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া প্রথম ও সপ্তম অভিযোগ বদিউজ্জামান ও দারাসহ ছয়জনকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় কামারুজ্জামানের। শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানের প্রতি অমানবিক আচরণের দায়ে কামারুজ্জামানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
প্রথম অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ২৯ জুন মো. বদিউজ্জামানকে শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রাম থেকে আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্পে নিয়ে সারা রাত নির্যাতন ও পরদিন গুলি করে হত্যা করা হয়। এ মামলায় বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে সেনাদের কাছে হস্তান্তর করে হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে উৎসাহ জোগানো, উসকানি ও সহায়তাদানের বিষয়টি প্রসিকিউশন সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ করতে সক্ষম হন।
দ্বিতীয় অভিযোগ : কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় ঘোরায় এবং চাবুকপেটা করে। হান্নানের প্রতি এ ধরনের অমানবিক আচরণে আসামির পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন ছিল বলে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তৃতীয় অভিযোগ : রাষ্ট্রপক্ষের ১১, ১২ ও ১৩ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য অনুসারে একাত্তরের ২৫ জুলাই আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য এবং পাকিস্তানি সেনারা সম্মিলিতভাবে সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ করে।
যৌন নির্যাতনের শিকার ওই তিন নারীর সাক্ষ্যে এ ঘটনায় কামারুজ্জামানের অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। কামারুজ্জামান এ ঘটনা জানতেন এবং তিনি এখানে উপদেষ্টার ভূমিকায় ছিলেন। ফলে সোহাগপুরে দলগতভাবে শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা ও ধর্ষণের দায় তাঁর ওপর পড়ে। অভিযোগটি রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়।
চতুর্থ অভিযোগ : রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় ও পঞ্চম সাক্ষীর সাক্ষ্য অনুসারে গোলাম মোস্তফাকে সুরেন সাহার বাড়িতে স্থাপিত আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে তাঁকে হত্যার অভিযোগটিও রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়।
পঞ্চম অভিযোগ : এ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষের ৭ ও ১৪ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্যে, ঝিনাইগাতীর আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্পে বন্দী ১১ জনের আটজনকে গুলি করে হত্যার বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি। ১৪ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য অনুযায়ী ওই দিন কামারুজ্জামানের নির্দেশে চারজন বন্দীকে হত্যা করা হয়।
ষষ্ঠ অভিযোগ : কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে টুনু হত্যার জন্য আনা অভিযোগটিও রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষীর বক্তব্যে আসামির ময়মনসিংহের জেলা কাউন্সিল ডাকবাংলোয় স্থাপিত আলবদর ক্যাম্পে যাতায়াত করা এবং রাতের বেলা বিভিন্ন অভিযানে যাওয়ার বিষয়টি টুনুকে ক্যাম্পে নিয়ে হত্যার অভিযোগ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া মামলার রায়ে উল্লেখ করা হয়, সাক্ষী অনির্দিষ্ট কারো কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ শুনে সাক্ষ্য দিয়েছেন, যার ওপর ভিত্তি করে কাউকে অপরাধের জন্য দায়ী হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
সপ্তম অভিযোগ : এ অভিযোগে প্রথম, নবম, ১৫তম সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কামারুজ্জামান জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর আলবদর ক্যাম্পের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পদ্ধতি কামারুজ্জামান পরিচালনা করতেন। ওই পদ্ধতির মাধ্যমেই দারা ও তাঁর বাবা টেপা মিয়াকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়।