মুক্তিযোদ্ধার জমি এমপির নামে দখল
রাজধানীর মিরপুরে এক ব্যক্তির জমি দখল করে আওয়ামী লীগের কার্যালয় তৈরির অভিযোগ উঠেছে। মধ্য পীরেরবাগের যে স্থানে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয় তৈরি করা হচ্ছে সেটি আব্দুল মান্নান নামের এক মুক্তিযোদ্ধার।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা-১৫ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আওয়ামী লীগ নেতা কামাল আহমেদ মজুমদারের নেতৃত্বে এই দখলের কাজ চলছে। যদিও জমিটিতে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ না করতে আদালতের নির্দেশ রয়েছে। তবু থেমে নেই দখলের কাজ।
এ বিষয়ে গত জানুয়ারি ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন মিরপুর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হুদা।
অবিভক্ত মিরপুর থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নানের ছেলে মো. মোস্তাক আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ২৭৫/এ নম্বর মধ্য পীরেরবাগের প্লটটিতে তাদের বেশকিছু দোকান ছিল। সেগুলো তারাই দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করছিলেন। গত বছরের ১৪ নভেম্বর সকালে হঠাৎ করেই ১৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা (প্রস্তাবিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক) আবুল কালাম আজাদসহ বেশ কয়েকজন জোর করে তাঁদের দোকানপাট ভেঙে দেয়। এরপর সেখানে তারা নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে।
মোস্তাক জানান, কারণ জানতে চাইলে আজাদ বলেন, এমপি সাহেবের নির্দেশে তাঁরা এ কাজ করছেন। ফলে বিষয়টির সুরাহা করতে পরের দিন মোস্তাক স্থানীয় সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের কাছে যান। কিন্তু তিনি সুরাহা না করে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংসদ সদস্যকে অভিযোগ জানানোর পরের দিন মোস্তাকদের ওই জমিতে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে লেখা- ‘১৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের স্থায়ী কার্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর মিরপুর থানা, ক্রয় সূত্রে মালিক : বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ কামাল আহমেদ মজুমদার, মাননীয় সংসদ সদস্য ১৮৮, ঢাকা-১৫।’
এরপর বিষয়টি নিয়ে মোস্তাক আহমেদ বেশ কয়েকবার কামাল আহমেদ মজুমদারের কাছে গেছেন কিন্তু তাঁর নামে যারা জমি দখলের কাজ করছিল তারা কাজ চালিয়ে যেতে থাকে বলে জানান মোস্তাক। সমস্যার কোনো সমাধান না দেখে গত ২০ নভেম্বর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের শরণাপন্ন হন মোস্তাক।
আদালত ওই জমির ওপর স্থগিতাদেশ জারি করলেও কাজ বন্ধ করেননি দখলদাররা। বরং মোস্তাকদের প্রায় কোটি টাকার সম্পত্তি এবং সিটি করপোরেশনের কিছু জায়গা দখল করে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে চারতলা ভবন।
আদালতে মোস্তাক আহমেদের দায়ের করা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত শেষে গত ১৬ জানুয়ারি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন এসআই নাজমুল হুদা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মিরপুরের ২৭৫/এ নম্বর মধ্য পীরেরবাগের ওই নালিশি সম্পত্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সামনের জায়গা দখল করে পাকা ভবন নির্মাণ করেছেন বিবাদী পক্ষের লোকজন। নির্মাণাধীন ভবনের সামনে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে- ‘ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক স্থানীয় সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার।’
ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত কর্মকর্তা জানতে পারেন, দখলকৃত ওই জমিতে স্থানীয় সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন আজাদ নামের এক ব্যক্তি দ্রুত ভবন নির্মাণকাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ তথ্য জানার পর তদন্ত কর্মকর্তা এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে দুই পক্ষকেই নোটিশ দেন। উভয় পক্ষকে তাদের দাবির পক্ষের দলিল প্রদর্শনের অনুরোধ করে দেওয়া ওই নোটিশ গ্রহণ করেন বাদী পক্ষে মো. মোস্তাক আহমেদ এবং বিবাদী পক্ষে মো. আবুল কালাম আজাদ। এই নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে বাদীপক্ষ মালিকানা সংক্রান্ত দলিল তদন্ত কর্মকর্তার সামনে প্রদর্শন করলেও বিবাদী পক্ষ কোনো নথি উপস্থাপন করেনি।
বাদীপক্ষের দাখিল করা দলিল ও অন্যান্য নথি পর্যালোচনা করে এসআই নাজমুল প্রতিবেদনে জানান, সিএস ও এসএ খতিয়ানে মালিক মালেক মোহাম্মদের কাছ থেকে ১৯৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর সাবকবলা দলিলমূলে এই জমিটি কেনেন আব্দুল গফুর নামে এক ব্যক্তি। পরে ১৯৭৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাদীর বাবা মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মো. আব্দুল মান্নান ও মো. আব্দুল কাদের নামে এক ব্যক্তির কাছে জমিটি বিক্রি করেন।
এ বিষয়ে মোস্তাক আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, মো. আব্দুল মান্নান ও মো. আব্দুল কাদের ১৯৮৯ সালের ২ অক্টোবর আপসনামা দলিলের মাধ্যমে উভয়েই ৫.৫ শতাংশ দখলে নেন। পরে ৫৬৬৭ নম্বর দলিলমূলে আবদুল কাদের তার সম্পত্তি আবদুল বারেক নামের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। তবে ৬০ ফিট রাস্তা তৈরির জন্য আবদুল বারেকের ওই জমি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক রাস্তার জন্য অধিগ্রহণ করা হয়।
প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা জানান, অধিগ্রহণের বিপরীতে এলএ কেস নম্বর ভূমি২/২০১০-২০১১ মূলে ২০১২ সালের ২৯ মার্চ আবদুল বারেক সরকারের কাছ থেকে রিসিভ রসিদমূলে অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির মূল্য গ্রহণ করেন। এর ফলে আব্দুল বারেকের দখলকৃত সম্পত্তির সমুদয় মালিকানা স্বত্ব বিলুপ্ত হয় বলেও আদালতকে জানান তদন্ত কর্মকর্তা।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এই সম্পত্তি (এক দশমিক চল্লিশ অযুতাংশ) সাফ কবলা দলিলমূলে আব্দুল বারেক গত ১০ নভেম্বর স্থানীয় সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের কাছে বিক্রি করেন। এমনকি আদালতের নোটিশ পাওয়ার পরও একাধিকবার ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ করতে বললেও বিবাদীরা নালিশি সম্পত্তিতে সংসদ সদস্যের নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে সম্পত্তিতে জোর করে ভবন নির্মাণ করে যাচ্ছে। এতে যেকোনো সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ জানমালের চরম ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক নাজমুল হুদা এনটিভি অনলাইনকে জানান, তাঁর পর্যবেক্ষণগুলো তিনি প্রতিবেদনে লিখে আদালতে জমা দিয়েছেন। এর বাইরে কিছু বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
এনটিভি অনলাইনকে মোস্তাক আহমেদ জানান, তাঁর বাবা মরহুম আব্দুল মান্নান মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ দিয়েছিলেন।
১৯৭৮ সালে সহকর্মী আব্দুল কাদেরের সঙ্গে মিলে মধ্য পীরেরবাগের ১১ শতাংশের ওই জমিটি কেনেন আব্দুল মান্নান। সেই সময়ই সমহারে চুক্তিনামা ছিল প্রত্যেকের নামে সাড়ে ৫ শতাংশ করে।
বারবার কামাল আহমেদ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সমাধান পাননি জানিয়ে মোস্তাক আহমেদ আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার বাবা তাঁর সারাজীবনের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে এই জমিটুকু কিনেছিলেন। আমরা ১০ ভাইবোন কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছি। অথচ আমাদের দলের সংসদ সদস্যের কাছ থেকেই কোনো বিচার পাচ্ছি না।’
এ ব্যাপারে আজ মঙ্গলবার রাতে সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁকে পাওয়া যায়নি।