রাষ্ট্রধর্ম রিটের শুনানিতে যা হলো
সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটটি খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। রিটের শুনানিকালে আদালত বলেন, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্তির বিধান চ্যালেঞ্জ করে রিট করার এখতিয়ার নেই। তাই আবেদনটি খারিজ করা হলো এবং রুল ডিসচার্জ করা হলো।
আজ সোমবার দুপুরে বিচারপতি নাঈমা হায়দারের নেতৃত্বে বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ রিটটি খারিজ করে দিয়ে এ আদেশ দেন।
১৯৮৮ সালের ৫ জুন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম জাতীয় সংসদে পাস করা হয়। সংশোধনীতে ২(ক) অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ একই বছরের ৯ জুন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মধ্য দিয়ে এটা আইনে পরিণত হয়।
ওই বছরের আগস্টে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেনসহ দেশের ১৫ বিশিষ্ট নাগরিক এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। দীর্ঘদিন পর ২০১১ সালের ৮ জুন হাইকোর্টে একই বিষয়ে ফের সম্পূরক আরো একটি আবেদন করে রিটের শুনানির আবেদন করা হয়। পরে ওই আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেওয়া কেন অবৈধ, বেআইনি ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
আজ হাইকোর্ট রুলটি বাতিল করে দিয়ে রিটটি খারিজের আদেশ দেন।
রিটের এ শুনানিকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরেই হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে আসছিল। আজও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার দাবিতে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
আলোচিত এ রিটের শুনানিকে কেন্দ্র করে আদালত কক্ষের সামনে বাড়তি নিরাপত্তা নেওয়া হয়। আদালত কক্ষের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ১০-১২ জন সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়।
শুনানি শুরুর আগে সেখানে হাজির হন হেফাজতের ১২-১৩ জন নেতা। তাঁরা আদালতের কক্ষে প্রবেশ করতে চাইলে কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেন। পরে দুজনকে পুলিশ আদালত কক্ষে প্রবেশের অনুমতি দেন। এর বাইরে অর্ধশতাধিক সাধারণ মানুষ আদালত কক্ষের বাইরে অবস্থান নেয়। এ সময় আইনজীবী ও সাংবাদিকদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে আদালত কক্ষে প্রবেশের অনুমতি দেয় পুলিশ।
দুপুর ২টার দিকে শুনানির জন্য আদালত বসে। শুরুতে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা আদালতের উদ্দেশে বলেন, এটা অনেক আগের মামলা। দুটি রুল হয়েছে। অনেক পুরনো ম্যাটার। ১৯৮৮ সালের রিট। পরে দুটি সম্পূরক আবেদনের রুল দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আমাদের কিছু সময় প্রয়োজন।
এ সময় আদালত বলেন, ঠিক আছে, আপনি বসেন। আগে আবেদনকারীর আইনজীবীকে শুনব।
এরপর সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খান, এ বি এম নুরুল ইসলামসহ কয়েকজন আইনজীবী রিটের বিরুদ্ধে অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আবেদন নিয়ে দাঁড়ান।
কিন্তু আদালত বলেন, আপনারা এখন বসেন। এখনো শুনানিই শুরু হয়নি। আগে রিট আবেদনের আইনজীবীকে শুনব। পরে পক্ষভুক্ত হওয়ার বিষয়।
এ সময় আদালত আবেদনকারীর আইনজীবী সুব্রত চৌধুরীকে বলেন, ‘আপনাকে আমরা (আবেদনটি) দেখে আসতে বলেছিলাম, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে রিটটি দায়েরের এখতিয়ার ছিল কি?’
জবাবে রিটকারীদের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংগঠন ছাড়াও রিটটি আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকে আবেদনকারী হয়েছে।
আদালত বলেন, আমরা দেখছি ওই সংগঠনটির পক্ষে রিট আবেদন করা হয়েছে।
তখন অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, শুনানির সময় আমরা বিস্তারিত বলব। সন্তোষকজনক জবাব দেব।
আদালত বলেন, ‘ওই সংগঠনের রিট করার এখতিয়ার (লোকাল স্ট্যান্ড) নাই। রিট খারিজ, রুল ডিসচার্জ।’
এর পরই আদালতের বাইরে থাকা হেফাজতে ইসলামের দুই নেতা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ বলে স্লোগান দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা তাঁদের বাধা দেন।
পরে আদালত থেকে বেরিয়ে সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় দেখব কেন খারিজ হয়েছে। এরপর আপিল করব।’
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম বহাল থাকার পাশাপাশি অন্য ধর্মের অধিকারও বহাল থাকল। এটা সংবিধানেও রয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর শাখার যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ফজলুল করিম কাসেমী বলেন, ‘সরকারকে মোবারকবাদ। আল্লাহ ন্যায়বিচার করেছেন।’
রিট মামলটি করা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্তির বিধান করার পর। ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে রিটকারী ১৫ বিশিষ্টজনের মধ্যে অনেকে এরই মধ্যে মারা গেছেন।