৮০ পেরোলেন ফজলে হাসান আবেদ
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। ইউরোপের দেশগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে ইংল্যান্ড চলে গেলেন তিনি। তার পর শুরু করলেন প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ। গড়ে তুললেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন। আর যুদ্ধের পুরোটা সময় তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনে কাজ করেছে সংগঠনটি।
যাঁর কথা বলছি, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
যুদ্ধ শেষ হলো, সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ফিরে এলেন ফজলে হাসান আবেদ। একই সময়ে ফিরে আসতে শুরু করলেন ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি শরণার্থী। ভারত প্রত্যাগত এই শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন করার সিদ্ধান্ত নেন আবেদ। আর এ কাজে নিজের লন্ডনের ফ্ল্যাটটিও বিক্রি করে দিলেন তিনি। সেই অর্থ দিয়ে শুরু করলেন ত্রাণকাজ।
সেই থেকে নীরবে-নিভৃতে তিনি কাজ করে গেছেন বাংলাদেশের গ্রামের দরিদ্র মানুষের জীবন পরিবর্তনে। আর দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটেনের রানীর কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন যুক্তরাজ্যের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মানজনক উপাধি ‘নাইটহুড’। পেয়েছেন অসংখ্য জাতীয় আর আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তবু আজো নিভৃতচারী তিনি। শুধু কাজেই ডুবে থাকতে চান। তাই তো জীবনের ৮০টি বছর পার করে এসেও কাজ নিয়েই মেতে থাকতে চান।
১৯৩৬ সালের আজকের দিনে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ফজলে হাসান আবেদ। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর পর তিনি ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচার বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। পরে তিনি লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টসে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি তাঁর প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে দেশে ফিরে এসে ফজলে হাসান আবেদ শেল অয়েল কোম্পানিতে যোগ দেন এবং দ্রুত পদোন্নতি লাভ করে ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শেল অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত থাকাকালে ১৯৭০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এ সময় তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ‘হেলপ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে ঘূর্ণি উপদ্রুত মনপুরা দ্বীপের অধিবাসীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সেখানে তাঁরা ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিলেটের শাল্লা অঞ্চলকে ফজলে হাসান আবেদ বেছে নেন তাঁর কর্মএলাকা হিসেবে। এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায়ই তিনি গড়ে তোলেন ব্র্যাক। দরিদ্র মানুষ যেন নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে লক্ষ্যেই ছিল ব্র্যাকের নানা কর্মসূচি।
চার দশকের মধ্যে ব্র্যাক পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১১টি দেশে ব্র্যাকের লক্ষাধিক কর্মী প্রায় ১৩ কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নের স্পর্শ রেখে যাচ্ছে। ফজলে হাসান আবেদের সুযোগ্য নেতৃত্বই অজস্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্র্যাকের এই অর্জনকে সম্ভব করে তুলেছে।
বিশ্ব জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান এবং বিশ্বব্যাপী দরিদ্র লোকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ফজলে হাসান আবেদ ২০১৬ সালে ‘টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ’ পদক লাভ করেন। খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১৩ সালে তিনি হাঙ্গেরির ‘সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি’ (সিইইউ) কর্তৃক প্রদত্ত ‘ওপেন সোসাইটি প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১১ সালে তিনি কাতার ফাউন্ডেশন প্রবর্তিত শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ওয়াইজ প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১০ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ফজলে হাসান আবেদ যুক্তরাজ্যের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মানজনক উপাধি ‘নাইটহুড’ লাভ করেন।
মানবিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ব্র্যাক বিশ্বের সর্ববৃহৎ পুরস্কার কনরাড এন হিলটন হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড (২০০৮) এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (২০০৭) অর্জন করেছে।