সুন্দরবনে আগুন থেকে রক্ষা পাচ্ছে না প্রাণীও
পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের তুলাতুলি এলাকায় লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে এখনো বিভিন্ন স্থানে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তিনটি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ করছে। এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় এবং পানির সুব্যবস্থা না থাকায় আগুন নেভাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
নাশকতাকারীরা এবার কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অন্তত ২০টি স্থানে আগুন দিয়েছে। আগুনে গাছপালার পাশাপাশি বন্য প্রাণীও মারা পড়ছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন বনকর্মী বলেন, আগুনে কচ্ছপ, গুইসাপসহ ছোট-বড় সাপ পুড়ে মারা গেছে। এটি তাঁরা দেখেছেন এবং বন কর্মকর্তাদের নির্দেশে পরে তা সরিয়ে ফেলেছেন।
এদিকে সুন্দরবনে আগুন লাগার কারণে আজ শুক্রবার সকাল থেকে গোটা পূর্ব সুন্দরবন বিভাগজুড়ে জেলে, বাওয়ালি, মৌয়ালদের পাস পারমিট দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ। তবে বিদেশি পর্যটকরা অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবেন। এর আগে বৃহস্পতিবার শুধু চাঁদপাই রেঞ্জে সব ধরনের পাস পারমিট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত জেলে বাওয়ালি, মৌয়াল ও সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে বন বিভাগ। এ দুটি রেঞ্জজুড়ে টহল দিচ্ছেন র্যাব ও কোস্টগার্ড সদস্যরা।
শুক্রবার দুপুরে বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মো. জহির উদ্দিন আহমেদ নাশকতার আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে মো. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার কারণে তিনজন বনকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যাদের অবহেলায় সুন্দরবনে নাশকতা হচ্ছে, সেসব বিভাগীয় কর্মীর বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জহির উদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, সুন্দরবনে এবার দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনের ধরনটা একটু ভিন্ন। এই দুর্বৃত্তরা তুলাতুলি এলাকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২০টি স্থানে আগুন দিয়েছে, যা আমাদের শনাক্ত করতে সময় লেগেছে। যার কারণে আগুন নেভাতে সময় লাগছে। আগুন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। তবে এখনই ফায়ার সার্ভিসকে সুন্দরবন থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে না। তারা সুন্দরবন বিভাগের সঙ্গে আগুন লাগার এলাকায় থেকে পর্যবেক্ষণ করবে। তবে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা কয়দিন সুন্দরবনে থাকবেন, তা তিনি নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি।
বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মানিকুজ্জামান মানিক বলেন, ‘বুধবার সন্ধ্যা থেকে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ঘটনাস্থলের দুই কিলোমিটার দূর থেকে আমরা পানি এনে আগুন নেভানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। দমকলকর্মীরা প্রখর দাবদাহে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এ জন্য খুলনা ফায়ার সার্ভিস থেকে ১২ জনের একটি দল শুক্রবার সকালে সুন্দরবনে এসে কাজে যোগ দিয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় এখনো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে আগুন জ্বলে উঠছে। পুরোপুরি আগুন কখন নেভাতে পারব তা বলতে পারছি না।’
এদিকে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম সুন্দরবনে আগুন লাগার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগার ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে, সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা সুন্দরবন সুরক্ষায় মোটেও আন্তরিক নয়। সুন্দরবনে শুধু অগ্নিকাণ্ডই নয়, প্রতিনিয়ত বিষ দিয়ে মাছ ধরা, বাঘ-হরিণ শিকার, গাছ পাচারসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চলছে যার অধিকাংশই দৃশ্যমান নয়। বন সন্নিহিত লোকালয় শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জের শাসকদলের কতিপয় জনপ্রতিনিধি এবং তাঁদের আশ্রিত দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
আগুনের নেপথ্যে
সূত্র বলছে, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অনেক সময় অসাধু বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মাছ চাষ করতে পরিকল্পিতভাবে বনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর পেছনে রয়েছেন শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ উপজেলায় শাসকদলের কয়েকজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি।
১২ এপ্রিল রাতে এবং ১৮ এপ্রিল সকালে ও সর্বশেষ ২৮ এপ্রিল ভোরে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী বনে তিনবার আগুন লাগে। এরপরই এমন অভিযোগ করেন খোদ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, ১২ এপ্রিল রাতে ও ১৮ এপ্রিল সকালে সুন্দরবনে দেওয়া আগুনের ঘটনায় বন বিভাগ আদালত এবং শরণখোলা থানায় পৃথক দুটি মামলায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে। ওই দুটি নাশকতার আগুনের ঘটনায় শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাহজাহান হাওলাদার ওরফে শাহজাহান শিকারীকেও আসামি করা হয়।
সুন্দরবনের গহিন অরণ্য গত ১৪ বছরে এ নিয়ে ২২ বার আগুনে পুড়েছে। চলতি বছরের ২৮ মার্চ পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী এলাকায় লাগা আগুনে প্রায় দেড় একর এবং ১২ ও ১৮ এপ্রিল লাগা আরো দুটি নাশকতার আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ১০ একর বনভূমি। সর্বশেষ একই এলাকায় মাত্র এক মাসের মধ্যে চতুর্থবার ২৭ এপ্রিল ভোরে আগুন দেওয়া হয়। শুধু চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় লাগা আগুনে প্রায় ৭০ একর বন পুড়েছে।
এর আগে ২০০২ সালের ২২ মার্চ ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড কটকা অভয়ারণ্যের আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর পর থেকে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় শুরু হয় অগ্নিকাণ্ড।
আগুন দেওয়ার অভিযোগে আটক ১
চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের তুলাতুলি এলাকায় আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনায় জড়িত অভিযোগে আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় খলিলুর রহমান হাওলাদার (৩৫) নামে একজনকে আটক করেছে পুলিশ।
শরণখোলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম মিয়া জানান, সুন্দরবনে আগুন দেওয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িত এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে খলিলকে আটক করা হয়েছে। খলিল শরণখোলা উপজেলার উত্তর রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা।
গত ১৮ এপ্রিল আগুন লাগার ঘটনার পর ১৯ এপ্রিল শরণখোলা থানায় বন বিভাগের মামলা দায়েরের পর এই প্রথম একজনকে আটক করল পুলিশ।