নিজামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী, শাস্তির জন্য এটাই যথেষ্ট
‘মিস্টার হোসেন, আপনার রিভিউর লিখিত আবেদনে বলেছেন, নিজামী সাহেব পাক আর্মির (সেনাবাহিনী) সহযোগী ছিল। তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট।’
জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর রায় পুনর্বিবেচনার শুনানিকালে তাঁর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের উদ্দেশে উল্লিখিত কথা বলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে আদালতকক্ষে পিনপতন নীরব পরিবেশে নিজামীর রিভিউর শুনানি শুরু হয়।
শুনানির শুরুতে আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন নিজামীর পক্ষে বলেন, ‘নিজামী সাহেব আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিলেন, এ রকম কোনো তথ্য ছিল না। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে দালাল আইনে মামলা হয়েছিল। তখন নিজামীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। যুদ্ধের ৪২ বছর পর হঠাৎ করে আমার (নিজামী) নাম উঠে আনা হয়েছে।’
এর পর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘মিস্টার হোসেন (খন্দকার মাহবুব হোসেন), আপনারা রিভিউর লিখিত যে জবাব দাখিল করেছেন তাতে উল্লেখ রয়েছে, নিজামী সাহেব পাক আর্মিদের সহযোগী ছিল। তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট।’
ওই বক্তব্যের পর নিজামীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে নিজামী সাহেব তাঁদের সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনো হত্যাকাণ্ডে বা কোনো ঘটনায় সরাসরি সম্পৃত্ত ছিলেন না।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন এখনো আমাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে। সারা দেশে রাস্তাঘাট, কালভার্ট নেই। শুধু আগুন আর আগুন। এসব ভয়াবহ দৃশ্য মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। বিশেষ করে ২৬ মার্চ রাতে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা ছিল ভয়ানক।’
ওই সময় খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘যারা এ দেশে সরাসরি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। তাদের বিচার করা হয়নি। মূল হোতাদের ছেড়ে দিয়ে ৪০ বছর পর চুনোপুঁটিদের বিচার করা হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবেই এই বিচার করা হচ্ছে।’
এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন যে নৃশংসতা হয়েছে, সেটিকে কসোভো ও যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। এটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নৃশংসতার সঙ্গে তুলনা করতে হবে।’
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘যারা সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার ৪২ বছর পর এ বিচার শুরু হয়েছে। এ বিচারের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করে এক হাজার পৃষ্ঠার রায়ের দরকার কী? এত মানুষের শ্রমের দরকার কী? একসঙ্গে সবাইকে ঝুলিয়ে দিলে হয়।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মিস্টার হোসেন, আপনি ওখান থেকে দাঁড়িয়ে এসব শুনানি করতে পারেন। কিন্তু আমাদের তো সীমাবদ্ধতা আছে।’
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘শুধু রাজনৈতিক কারণে এ বিচার হচ্ছে। মূল হোতাদের ছেড়ে দিয়ে মতাদর্শের কারণে সমর্থনকারীদের বিচার করা হচ্ছে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাক সেনারা দুই মাসও এ দেশে অবস্থান করতে পারত না, যদি না তাদের আলবদর ও তাদের সহযোগীরা সহযোগিতা করত।’
খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘এত বছর পর বিচার শুরু হলো, ট্রাইব্যুনাল আমাকে (নিজামী) ফাঁসি দিল। সেটা যদি বহাল রাখা হয়, তাহলে এত টাকা, এত শ্রম এর দরকার কী? একসঙ্গে ঝুলিয়ে দিলে হয়।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা কাদের মোল্লার রিভিউর রায়ে এ বিষয়ে পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি। আমরা বিচারের নামে তামাশা চাই না। কারণ, এই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সারা বিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছে। এ জন্য সকল আইনি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এবং যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়, সে বিষয়টি লক্ষ রেখেই এই বিচার করা হচ্ছে।’
খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘মাই লর্ড, সারা বিশ্ব মৃত্যুদণ্ডকে অনুৎসাহিত করছে। আমার বয়স এখন আশির কাছাকাছি। বয়সের বিবেচনায় হলেও আমার দণ্ড কমিয়ে আনা হোক।’
উল্লেখিত কথা বলে খন্দকার মাহবুব হোসেন বেলা ১১টার দিকে শুনানি শেষ করেন।
এর পর রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানি শুরু করেন। শুনানিতে তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে নিজামীর অবস্থান তুলে ধরেন। একই সঙ্গে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে নিজামীর অবস্থান, আলবদর নেতা হিসেবে নিজামীর উসকানিমূলক বক্তব্য আদালতের সামনে তুলে ধরে তাঁর মৃত্যুদণ্ড বহালের আবেদন করেন। দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে শুনানি শেষ হওয়ার পর আদালত রিভিউর রায়ের জন্য ৫ মে দিন নির্ধারণ করেন।