জংলি আলু খেয়ে বেঁচে আছে থানচির মানুষ
বান্দরবানের থানচি উপজেলায় দূর্গমাঞ্চলের একাধিক পাহাড়ি গ্রামে চালের সংকট দেখা দিয়েছে। চালের অভাবে ভাত খেতে না পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা জংলি আলু, কলা গাছসহ ফলমূল খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিগত বছরে পাহাড়ে চাষ করা জুমের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি তারা। আর এ কারণেই এ সংকট দেখা দিয়েছে। চলতি বছর মার্চ মাস থেকে চালের এ সংকট দেখা দিয়েছে।
দ্রুত সংকট মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে দুই দফায় বরাদ্দ দেওয়া ৪৬ টন চাল দুর্গত এলাকায় পাঠানো হয়েছে। তবে সাঙ্গু নদীতে পানি না থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুর্গম এলাকাতে চাল পাঠাতে দেরি হচ্ছে বলে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন জানিয়েছে, জেলার থানছি উপজেলার রেমাক্রী, তীন্দু, সদর এবং বলিপাড়া ইউনিয়নের দুর্গমাঞ্চলে জিন্নাপাড়া, বাকলাইপাড়া, দলিয়ানপাড়া, বড়মদক ভিতরপাড়া, হৈয়োক খুমীপাড়া, যোগীচন্দ্রপাড়া, দুলুপাড়া, রেমচংপাড়াসহ আশপাশের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে ভাতের চালের সংকট দেখা দিয়েছে। ইউনিয়নগুলোর প্রায় আড়াই হাজারের মতো মানুষ চরমভাবে খাদ্য সংকটে ভুগছে। এ গ্রামগুলোতে বসবাসরত পাহাড়িদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে জুম চাষ। জুম চাষের মাধ্যমেই তারা সারা বছরের ধানসহ অন্যান্য ফসল সংগ্রহ করে রেখে আদিকাল থেকে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। কিন্তু গতবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জুমের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি পাহাড়িরা। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে পাহাড়িদের প্রতিটি পরিবারে চালের সংকট তৈরি হয়েছে। চালের সংকটে ভাতের ক্ষুধা পাহাড়িদের চোখে মুখে জ্বলজ্বল করছে। অনেক পরিবার আছে যাদের দুই বেলাই মিলছে না ভাত। অনেকে আবার একবেলা ভাত অন্যবেলা আলু বা মিষ্টি কুমড়া খেয়ে জীবন বাঁচাচ্ছে। এলাকাগুলোর বেশির ভাগ মানুষই পাহাড়ি আলু, লতা-কলা গাছের ভিতরের সাদা অংশ খেয়ে ক্ষুধা মেটাচ্ছে।
হৈয়োক খুমীপাড়া কারকারি (গ্রাম প্রধান) হৈয়ুক খুমি বলেন, ‘আমার পাড়ায় বসবাসরত ২৭টি পরিবারের মধ্যে কারো ঘরে একমুঠো খাবারের চাল নেই। প্রতিটি পরিবারই চরম খাদ্য সংকটে রয়েছে। চালের অভাবে পাহাড়ের আলু, লতা-পাতা খেয়ে জীবনযাপন করছে পাহাড়িরা। এ অঞ্চলের পাহাড়িদের জীবন বাঁচাতে সরকারের কাছে দ্রুত আতব চাল সরবরাহ করার দাবি জানাচ্ছি।’
যোগীচন্দ্রপাড়ার বাসিন্দা হাতিরাম ত্রিপুরা বলেন, ‘ভাতের চাল মজুদ না থাকায় পরিবারের ছয়জন সদস্য কয়েকদিন ধরে ভাত না খেয়ে ছিল। পরে বিজিবির নির্মাণাধীন একটি ক্যাম্পে কাজ করে ১০ কেজি চাল পেয়ে কয়েকদিন ধরে ভাত খাচ্ছি। শেষ হলে আবার কোথায় থেকে ভাত খাব, সেটি জানি না।’
বড়মদক ভিতরপাড়ার বাসিন্দা ৭৫ বছরের বৃদ্ধ ক্যমং উ মারমা ও ষাটোর্ধ্ব স্ত্রী মাম্যাচিং দম্পতি জানায়, তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনের সঙ্গে মেয়ের ঘরের দুই নাতনিও রয়েছে পরিবারে। পাহাড়ে কোথাও কোনো কাজের সুযোগ নেই। চিকিৎসার অভাবে একটি চোখ নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তার সঙ্গে ভাতের অভাব। ঘরে খাবারের চাল না থাকায় স্ত্রী মাম্যাচিং জঙ্গলে গিয়ে পাহাড়ি আলু সংগ্রহ করে এনেছেন। সেগুলো সিদ্ধ করে খেয়ে কোনো রকম প্রাণে বেঁচে আছেন তাঁরা।
রেমাক্রী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মাংচং বলেন, ‘সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকাগুলোতে কয়েকটি পাহাড়ি গ্রাম রয়েছে। পাড়াগুলোর বাসিন্দাদের কারোর কাছেই খাবারের চাল মজুদ নেই। জুমের ধান শেষ হয়ে যাওয়ায় পাড়াগুলোতে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। খাবারের কষ্টে মানুষজন জংলি আলু, মিষ্টিকুমড়া আর কলাগাছ খেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।’
রেমাক্রী ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মুই শৈ থুই মারমা রনি বলেন, রেমাক্রী ইউনিয়নে ৯৫ শতাংশ মানুষই জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। গত বছর জুমধান ভালো না হওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়েছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পরিবার। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে বাজার জাতের সুযোগ না থাকায় বাগানের ফল গাছেই পচে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে জুমের ধানের ওপর নির্ভরশীল পাহাড়িরা। জুমের ধান হলে মুখে হাসি থাকে পাহাড়িদের। আর জুম চাষে ধানের ফলন না হলে দুর্ভিক্ষের ছাপ লেগে থাকে সবার চোখে মুখে।
মুই শৈ থুই মারমার দাবি, বর্ষায় আগামী তিন মাস সারা দেশের সঙ্গে দুর্গম অর্ধশতাধিক গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন এ খাদ্য সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। ইতিমধ্যে অনেক পরিবার সংকটাপন্ন । সেই কারণে সংকট নিরসনে দ্রুত সরকারি-বেসরকারিভাবে খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।
তিন্দু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মংপ্রু অং মারমা বলেন, তিন্দু ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোতে প্রায় ছয়-সাতশ পরিবার এখন খাদ্য সংকটে ভুগছে। সরকারের আমলে নানামুখী উন্নয়ন হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গমাঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়িদের আর্থসামাজিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। চালের অভাবে পাহাড়ি মানুষগুলো না খেয়ে আছে। দ্রুত খাদ্য না পেলে খাদ্যের অভাবে মানুষ মারা যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বনিক বলেন, থানছি উপজেলার দুর্গত এলাকাগুলোতে দুই দফায় ৪৬ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে দুই হাজার ৩০০ পরিবারের জন্য এ চাল দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে দুর্গত এলাকাগুলোতে বরাদ্দের চাল সংকটাপন্ন পরিবারগুলোর মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। সাঙ্গু নদীতে পানি না থাকায় খাদ্য পৌঁছাতে কিছুটা সময় লেগেছে।
জেলা প্রশাসক আরো বলেন, আগামী অক্টোবর মাস পর্যন্ত চালের এ সংকট পাহাড়ি গ্রামগুলোতে থাকবে। কিন্তু সরকারের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য মওজুদ আছে। সংকটে ভয়ের কোনো কারণে নেই। যত দিন পর্যন্ত প্রয়োজন সরকার চালের ব্যবস্থা করবে। আগামীতে যেন এ সংকট তৈরি না হয়, সেজন্য দুর্গমাঞ্চলগুলোর মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলা প্রশাসন সম্মেলনকক্ষে সংকট মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিংয়ে কথাগুলো বলেন জেলা প্রশাসক। এ সময় অন্যদের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু জাফর, থানছি উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা চাহেলী তস্তরীসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।