পুরোহিত আনন্দ হত্যাকাণ্ডে জঙ্গিরা জড়িত : ডিআইজি
অন্যান্য দিনের মতো আজ সকালের পূজা শেষ করেন পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী। প্রতিদিনের মতো বাইসাইকেলটি হাতে নেন। স্ত্রী শেফালীকে জিজ্ঞাসা করেন, তরি-তরকারি লাগবে কি না। এরপর রওনা দেন নলডাঙ্গা মন্দিরের দিকে। সেখান এক পূজা অনুষ্ঠানে তাঁর থাকার কথা।
তখনো কি জানতেন এটাই তাঁর শেষ যাত্রা? আজ মঙ্গলবার সকালে সদর উপজেলার মহিষাডাঙ্গা ভাগাড় এলাকায় দুর্বৃত্তরা আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে গলা কেটে হত্যা করে। বিকেলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এ হত্যার দায় স্বীকার করে জঙ্গি সংগঠন আইএস।
আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীর (৭০) লাশের ময়নাতদন্ত ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে করানো হয়েছে । পরে রাতে তাঁর লাশ গ্রামের করাতিপাড়া শ্মশানে দাহ করা হয়েছে। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত এ হত্যার ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান হাফিজুর রহমান।
লাশের সুরতহাল প্রস্তুতকারী সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীর হাত, মাথা, ঘাড়, গলাসহ বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মাথা গলা থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে দুপুর ১টার দিকে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম মনিরুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি এ সময় সাংবাদিকদের জানান, এ ঘটনার সাথে নিঃসন্দেহে জঙ্গি সংগঠন জড়িত। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করায় সারা দেশেই এভাবে অস্থিতিশীল করে তোলা হচ্ছে। যারা স্বাধীনতা বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তারাই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।’
ডিআইজি আরো বলেন, ‘এর আগে খ্রিস্টান চিকিৎসক সমির খাজা ও শিয়া ধর্মাবলম্বী হোমিও চিকিৎসক কালীগঞ্জের আবদুর রাজ্জাক হত্যার সঙ্গে এ ঘটনার মিল আছে।’
ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ জানিয়েছেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষ করে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি কালীগঞ্জ থানায় পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে ডিআইজি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আটক করার জন্য কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। সেই মোতাবেক গোটা জেলার বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের অভিযান শুরু করার খবর নিশ্চিত করেছে পুলিশের একটি সূত্র। তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কাউকে আটক করা হয়নি বলে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ।
আজবাহার আলী শেখ আরো জানান, সকাল ১০টার দিকে এ খুনের খবর পান তাঁরা। এরপর ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং লাশের সুরতহাল তৈরি করেন। বিকেল ৩টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে প্রথমে নলডাঙ্গা মন্দির ও পরে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল মর্গে আনা হয়।
স্থানীয় নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আবদুর রশিদ জানান, আনন্দ গোপাল তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন। প্রতিদিন তিনি বাইসাইকেলে চড়ে নলডাঙ্গা মন্দিরে পূজা করতে যেতেন। এ রকম একজন ভালো মানুষকে হত্যা করা অন্যায় বলে আবদুর রশিদ মনে করেন।
সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউপির নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান কবীর হোসেন জানান, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হেলমেট পরা দুর্বৃত্তরা আনন্দ গোপালকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। নিজ বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে মহিষের ভাগাড় এলাকায় তিনজন হেলমেট পরা মোটরসাইকেল আরোহী আনন্দ গোপালের গতিরোধ করে মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। আঘাতের পর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে দুর্বৃত্তরা তাঁকে কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
নিহত আনন্দ গোপালের দুই ছেলে তিন মেয়ে। এঁরা হলেন বড় ছেলে অরবিন্দু গাঙ্গুলি মুদি দোকানদার, ছোট ছেলে সিন্ধু গাঙ্গুলী স্কুল শিক্ষক, মেয়ে রিনা (বড়), মিনা (মেজ ) ও অর্চনা (ছোট)। স্ত্রীর নাম শেফালী খাতুন। ছেলে অরবিন্দু গাঙ্গুলি জানান, এলাকায় ভালো মানুষ হিসেবে তাঁর বাবা আনন্দ গোপালের পরিচিতি ছিল। প্রত্যক্ষ কোনো শত্রুও ছিল না তাঁর।
সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুকদার, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাফিজুর রহমান ও ঝিনাইদহ র্যাব ৬-এর কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ পূঁজা উদযাপন পরিষদের ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সভাপতি প্রফুল্ল কুমার সরকার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আটক ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। তিনি জানান, এ নিয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আগামীকাল বুধবার সভা করে সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা।
এ নিয়ে গত ১৯ ঘণ্টায় ঝিনাইদহ জেলায় তিনজন নিহত হন। অপর দুজন হলেন হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আনোয়ারা প্রাইভেট হাসপাতালের মালিক নজরুল ইসলাম ও দারিয়াপুর গ্রামের আলফাজ উদ্দীন। গতকাল সোমবার তাঁরা পৃথক স্থানে খুন হন।
গত ৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বেলেখালে কালুহাটি গ্রামের খ্রিস্টান হোমিও চিকিৎসক সমির উদ্দিন (৮৫) ও ১৪ মার্চ খুন হন একই উপজেলার খড়াশনি গ্রামের হোমিও চিকিৎসক শিয়া মতাদর্শের আবদুর রাজ্জাক। এ দুই খুনের সঙ্গে আনন্দ গোপালের হত্যার মিল আছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।