মোবাইলের ভাস সেবাখাতে হঠাৎ অস্থিরতা
মোবাইল টেলিফোন অপারেটরদের মাধ্যমে পরিচালিত সেবাখাত ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসের (ভাস) পার্টনার হিসেবে কাজ করা দেশীয় ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো হঠাৎ করেই চরম ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছে। মোবাইল ফোনের গ্রাহকদের জন্য নিত্যনতুন কনটেন্ট তৈরি করে দেশীয় এসব প্রতিষ্ঠান মোবাইল কোম্পানিগুলোর ভাস সেবা খাতের অর্থ আয়ের চালিকাশক্তি হলেও অর্জিত আয়ের সিংহভাগই চলে যায় মোবাইল ফোন অপারেটরদের পকেটে। সম্প্রতি বড় একটি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি তাদের বিদ্যমান রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের হার ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে প্রায় অর্ধেক করার প্রস্তাব দেওয়ায় দেশীয় এসব কনটেন্ট প্রোভাইডার (সিপি) প্রতিষ্ঠান চরম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে। এ অবস্থায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম ভাস নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের হার অপরিবর্তিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসিও গত মঙ্গলবার এ বিষয়ে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে।
এখন কোনো পরিবর্তন চায় না সরকার
প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম গতকাল বুধবার এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ভাস নীতিমালা অনুমোদন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান ও চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদ্যমান শর্ত মেনেই রাজস্ব ভাগাভাগিসহ অন্যান্য কাজ করতে হবে। ভাস সংযোগের অপেক্ষায় থাকা নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই যেতে হবে।
প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ভাসে রাজস্ব ভাগাভাগিসহ বিভিন্ন বিষয়ে এখন আর কোনো পরিবর্তন চায় না সরকার। ভাস নীতিমালাটি জনমত জরিপের জন্য দেওয়া হয়েছে। মতামত নেওয়ার পর অনুমোদনের বিষয়টি আসবে।’ এখন আমরা নীতিমালার জন্য অপেক্ষা করছি। যারা নতুন আসবে সেবা প্রদান করতে তাদের ক্ষেত্রেও ওই নির্দেশনাই থাকবে। কারণ এখন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে নীতিমালার পরে তা আবারো পরিবর্তনের বিষয় আসতে পারে। আমরা তা করতে চাচ্ছি না।’
সক্রিয় বিটিআরসি
মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর হঠাৎ এই তৎপরতায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিটিআরসিও। গত মঙ্গলবার মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি, এয়ারটেল, টেলিটক ও প্যাসেফিক টেলিকমকে (সিটিসেল) পাঠানো বিটিআরসির নির্দেশনায় বলা হয়, ‘যুগোপযোগী ভাস গাইডলাইন প্রণয়নকল্পে প্রয়োজনীয় খসড়া বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের বিবেচনাধীন রয়েছে। ভাস গাইডলাইন চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে বিদ্যমান রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের হার অপরিবর্তিত রাখার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
সব কিছুই কনটেন্ট প্রোভাইডারের
একাধিক কনটেন্ট প্রোভাইডার (সিপি) কোম্পানির মালিক এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন, মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো পরিচালিত ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসের (ভাস) পার্টনার হিসেবে কাজ করছে তাদের পরিচালিত দেশীয় এসব ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান। মোবাইল ফোনের গ্রাহকদের জন্য কনটেন্ট তৈরি করা, এর জন্য নিত্যনতুন সার্ভিস উদ্ভাবনে গবেষণা, লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে সার্ভার বসানোসহ অবকাঠামো তৈরি করতে হয় তাঁদেরকেই। বিপুল এসএমএস এবং ওয়াপ সার্ভিস পরিচালনা করতে প্রচুর জনবলের প্রয়োজন হয়। তাদের বেতন-বোনাসসহ অফিস পরিচালনার খরচ মেটাতে হয় তাদেরকেই। এরপর সিপি থেকে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর সার্ভারে সেই এসএমএস এবং ওয়াপ কনটেন্ট পৌঁছাতে দ্রুতগতিসম্পন্ন অপটিক ফাইবারের ভিপিএন সংযোগের জন্যও প্রতি মাসে তাদের বিপুল অর্থ গুনতে হয়। মোবাইল ফোন অপারেটররা তাদের বিপুল অর্থব্যয়ে তৈরি করা এসব কনটেন্ট গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে শুধু প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তবুও অবহেলা
এসএমএস, ভয়েস এবং ওয়াপ সেবা দেওয়ার জন্য শর্টকোডের অনুমোদন দেয় বিটিআরসি। বিটিআরসির কর্মকর্তারা সার্ভিসের গুরুত্ব বুঝে দক্ষতার সঙ্গে অল্প সময়ে শর্টকোড বরাদ্দ করেন। কিন্তু শর্টকোড বরাদ্দের পরই মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাছে সংযোগের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে শুরুতেই হোচট খেতে হয় দেশীয় ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংযোগ পেতে এক থেকে দেড় বছর সময়ও লেগে যায়। এ দীর্ঘ সময়ে অফিস, জনবল ও বিপুল অবকাঠামো ব্যয় গুনে শুরুতেই ক্ষতির মুখে পড়তে হয় ক্ষুদ্র সিপি কোম্পানিগুলোকে।
হাজার কোটি টাকার শিল্প হতে পারে
ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ওয়েব এবং মোবাইল অ্যাপলিকেশন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ‘এভাটিক্স’-এর চেয়ারম্যান সুফি ফারুক। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, মোবাইল ফোন অপারেটররা (টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান) শুধুই প্ল্যাটফরম দেয়। কারিগরি দিকসহ নিত্য নতুন ধারণা তৈরি, গবেষণা, কনটেন্ট তৈরির কাজটি করে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই। বর্তমানে ভাসের ২০০ কোটি টাকার বাজার রয়েছে। যথাযথ সুযোগ পেলে তা হাজার কোটি টাকার শিল্প হতে পারে। অথচ নীতিমালার অভাবে মোবাইল ফোন অপারেটররা নিজেদের ইচ্ছেমতো বিষয়টি পরিচালনা করছে। লাভের বেশির ভাগ অংশ চলে যাচ্ছে মোবাইল ফোন অপারেটরদের হাতে।’
সুফি ফারুক বলেন, ‘ভাসের সেবা খাতের অর্জিত অর্থের প্রায় ৭০-৮০ ভাগ চলে যায় মোবাইল ফোন অপারেটরদের হাতে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল বলে মোবাইল ফোন অপারেটররা নিজেদের মতো করে চুক্তি করে। আমরা বলছি, এখানেই অন্যায় হচ্ছে। এর প্রতিকার দরকার। আর এ কারণেই নীতিমালা প্রয়োজন।’
বিটিআরসির নির্দেশনাকে সাংঘর্ষিক মনে করছে গ্রামীণফোন
দেশের বৃহত্তম টেলিযোগযোগ প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন বিটিআরসির ওই নির্দেশনাকে মনে করছে সাংঘর্ষিক। এ ব্যাপারে গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মাহমুদ হোসেন আজ বৃহস্পতিবার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নির্দেশনাটি আমাদের বাণিজ্যিক অধিকার এবং ব্যবসায়িক স্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক বলে আমরা মনে করছি। আমরা মনে করি পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার তাগিদে বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসায়িক দর কষাকষির স্বাধীনতা আমাদের থাকা উচিত। যার মাধ্যমে আমাদের গ্রাহকরাই সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এ বিষয়টি নিয়ে ভবিষ্যতে আমরা নিয়ন্ত্রণ সংস্থাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করব।’
আগের অবস্থানেই রবি
এ ব্যাপারে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের কমিউনিকেশনস অ্যান্ড করপোরেট রেসপনসিবিলিটি বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইকরাম কবীর এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ভাসে রাজস্ব আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা আগের অবস্থানেই আছি। এটি নিয়ে আমরা নড়চড় করিনি। অন্যরা করে থাকতে পারে। এখন সরকার নির্দেশনা দিয়েছে। তা আমরা অবশ্যই মেনে চলব।’
ইকরাম কবীর আরো বলেন, ‘তবে ভেন্ডর টু ভেন্ডর দর উঠানামা করে। এসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়।’