সাক্ষাৎকার
‘অবাস্তব কোনো স্বপ্ন দেখাচ্ছি না’
আনিসুল হক। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে উপস্থাপনা করে পরিচিতি ও সুনাম অর্জন করেন। বর্তমানে মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা আছে। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) ও সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদপ্রার্থী। এ নিয়ে এনটিভি অনলাইনের কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো :
প্রশ্ন : কোন প্রেক্ষাপট থেকে নির্বাচনে আসার পরিকল্পনা?
আনিসুল হক : মেয়র পদে নির্বাচন করব—এটা আমার পরিকল্পনায় ছিল না। আমি ব্যবসায়ী। অর্থনীতি, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করেছি। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআই ও সার্ক চেম্বারের নেতৃত্বে ছিলাম। এসব সংগঠনে কিছু ভালো কাজ করতে পেরেছি, যা করতে গিয়ে দল-মত নির্বিশেষে সবার সমর্থন পেয়েছি। যেখানে, যখনই দায়িত্বে ছিলাম, সততার সঙ্গে কাজ করেছি। এটাই আমার প্রধান সক্ষমতা। আমার মনে হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভেবেছেন, ঢাকা উত্তরের নাগরিকদের জন্য আমি ভালো কাজ করতে পারব। তাই আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। অন্যদিকে পরিবারের সদস্যরাও বিশ্বাস করে, জনগণ নির্বাচিত করলে আমি সত্যিই জনগণের কল্যাণে কিছু করতে পারব। ফলে তারাও আমাকে নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিত করেছে।
এটি আমার জন্য বিশাল একটি সুযোগ, ঢাকাবাসীর জন্যও। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন পরিচালনায় আমার উদ্যম, সততা ও সাফল্যের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি ঢাকা উত্তরকে নতুন চেহারা দিতে পারব।
প্রশ্ন : নির্বাচনে প্রার্থীরা কমবেশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আপনাকে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছে। তবে আপনি দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সেভাবে কখনো মাঠে ছিলেন না। নেতাকর্মীদের সঙ্গেও সেভাবে যোগাযোগ ছিল না। সেখানে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে কীভাবে মোকাবিলা করবেন?
আনিসুল হক : হ্যাঁ, সত্য। আমি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে ছিলাম না। কিন্তু বরাবরই আমি রাজনীতিসচেতন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ। নিজে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে সমর্থন দিচ্ছেন, তাঁর দল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এরই মধ্যে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁরাই আমার নির্বাচনী প্রচার এগিয়ে নেবেন। সবাই আমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। পাশে থাকার, ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, সমর্থন দিচ্ছেন, উৎসাহ জোগাচ্ছেন। ফলে আমি তো কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতা অনুভব করছি না।
প্রশ্ন : কোন শ্রেণির ভোটার মূল ব্যবধান গড়বে বলে ধারণা?
আনিসুল হক : ভোটারের শ্রেণিবিভাজনে আমি বিশ্বাস করি না। গরিব-ধনী সবারই এক ভোট। নগরীর সব ভোটারই সমান গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিক সেবায় সবার সমান অধিকার। তার পরও যেটি বিবেচ্য তা হলো, এই শহরের অর্ধেকের বেশি মানুষ স্বল্প ও নিম্ন আয়ের। সংখ্যার বিচারে তারাই শহরে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্যদিকে ঢাকা উত্তরে বিশাল একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি আছে। এবার ৩২ শতাংশ তরুণ জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দেবে। তরুণ ও নারীরা মোট সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। ফলে আমি সব শ্রেণির ভোটারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি। টেবিল ঘড়ি মার্কায় ভোট দিতে অনুরোধ জানাচ্ছি। আশা করি, নাগরিকরা শেষ পর্যন্ত আমাকেই বিজয়ী করবে।
প্রশ্ন : জয়ের ব্যাপারে কতটা আশাবাদী?
আনিসুল হক : ইনশাআল্লাহ, জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। না হলে তো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতাম না। দেখেন, এই শহরের মানুষ আমাকে জানে, চেনে। তাঁরা আমাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন দিচ্ছেন। দল-মত নির্বিশেষে পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। জনগণ বিশ্বাস করে, আমি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। তারা চায়, আমি তাদের সঙ্গে থেকে ঢাকার উন্নয়নে কাজ করি। মানুষের এই প্রত্যাশার জয় হবেই হবে।
প্রশ্ন : ঢাকাকে উন্নয়নের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে কিংবা কতটা যুক্তিযুক্ত?
আনিসুল হক : বাস্তবায়নযোগ্য জেনেই উন্নয়ন প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা ঢাকার সমস্যা জানতে প্রায় সব স্তরের নাগরিক, নগর বিশেষজ্ঞ, পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। তফসিল ঘোষণার বেশ আগেই প্রায় ৭৫ হাজার নাগরিকের ওপর জরিপ চালিয়েছি। ফলে এখন আমি নির্দিষ্ট করে নাগরিকদের চাহিদা কী, তা জানি এবং তার সমাধানে পরিকল্পনাও করেছি। আমরা এমন কোনো প্রস্তাব করছি না, যা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। আইনের মধ্যে থেকে মেয়র এসব কাজ তাঁর ক্ষমতা, দক্ষতা ও নেতৃত্ব দিয়ে খুব ভালোভাবেই বাস্তবায়ন করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করি না। ফলে নাগরিকদের অবাস্তব কোনো স্বপ্নও দেখাচ্ছি না।
পাশাপাশি, সিটি করপোরেশনের অপেক্ষায় না থেকে সরকারও শহরের জন্য বহু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্প যখন নেওয়া হয়, তখন কি কেউ ভেবেছিল, এগুলো বাস্তবায়িত হবে? বাস্তবতা হচ্ছে, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার হয়েছে, বনানী ফ্লাইওভার হয়েছে, হাতিরঝিল হয়েছে, মেট্রোরেলের কাজ চলছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে, রাস্তাঘাট প্রসারিত হচ্ছে, ভূগর্ভস্থ স্যুয়ারেজ লাইন উন্নয়নের কাজ চলছে; বহু কাজ হচ্ছে। এসব কাজ শেষ হলে শহরের চেহারা কেমন হবে—একবার ভেবে দেখুন তো।
প্রশ্ন : শৌচাগার ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরিকল্পনা?
আনিসুল হক : গত এক মাস আমরা এ বিষয়ে অনেক কাজ করেছি। আমার সহকর্মীরা এ বিষয়ে রীতিমতো গবেষণা করেছে। আমাদের পুরো শহরের গণশৌচাগারের অবস্থা সত্যিই করুণ। দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে শৌচাগার আছে মাত্র ৬৯টি, যার ৩৭টিই উত্তরে। এগুলোর অবস্থা এতই নাজুক যে সেখানে যেতে নাগরিকরা উৎসাহ বোধ করেন না। এ কারণে আমরা মেনিফেস্টোতে (ইশতেহার) বলেছি, জয়ী হলে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য করপোরেশনের পাঁচটি জোনে যথাসম্ভব বেশি বেশি করে গণশৌচাগার নির্মাণ করব। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করব। শৌচাগার ব্যবস্থাকেই ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেব।
প্রশ্ন : রাজধানীর বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কি চিন্তাভাবনা আছে?
আনিসুল হক : নিরাপদ বাজার আমাদের স্লোগান। আমরা নিরাপদ বাজারব্যবস্থা চাই। নিরাপদ বাজার ব্যবস্থাপনা চাই। ভেজালমুক্ত খাবার চাই। পরিচ্ছন্ন বাজার চাই। ক্রেতাবান্ধব পরিচ্ছন্ন বাজার চাই। যদি নির্বাচিত হই, অবশ্যই বাজার ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও নাগরিকের স্বাস্থ্যবান্ধব করে তুলব। সমস্যা বাজারের নয়, ব্যবস্থাপনার। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে বাজার ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন।
প্রশ্ন : একটি আধুনিক, পরিকল্পিত ঢাকার কাঠামো উন্নয়নে পাঁচ বছর সময়কে কি ট্রায়াল মেয়াদ বলে মনে করেন?
আনিসুল হক : আমি তো মনে করি, পাঁচ বছর অনেক সময়। সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে এ সময়ের মধ্যেই জনগণকে অনেক ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব। কাজের ধারাবাহিকতা থাকলে, ভালো কাজ পাঁচ বছরের জন্য নয়, বরং সব সময়ই চলতে পারে।
প্রশ্ন : ছেলেমেয়েরা কি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত?
আনিসুল হক : ছেলে নাভিদুল হক মোহাম্মদী গ্রুপের পরিচালক। ছোট মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে মাত্র গ্রুপে কাজ শুরু করেছে। আর আমাদের বড় মেয়ে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) হেডকোয়ার্টার (সদর দপ্তর) সুইজারল্যান্ডে চাকরি করে।
প্রশ্ন : নির্বাচিত হলে প্রথম কোন কাজে হাত দেবেন বলে ভাবছেন?
আনিসুল হক : পরিচ্ছন্ন-সবুজ-মানবিক-আলোকিত ঢাকা আমার অগ্রাধিকার। তবে সবার আগে যেটা করতে হবে, তা হলো মশার উপদ্রব থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে হবে। পর্যায়ক্রমে যানজট দূরীকরণসহ অন্যান্য বড় কাজে হাত দেব।
প্রশ্ন : রাজধানীর গণপরিবহন, যানজট নিয়ে বিশেষ কোনো ভাবনা আছে কি?
আনিসুল হক : অবশ্যই গণপরিবহন আমাদের অগ্রাধিকার। গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে ইশতেহারে আমরা বিস্তারিত বলেছি। আমাদের স্লোগান হচ্ছে সচল ঢাকা। যানজট নিরসনের কাজ মূলত ডিএমপির। কিন্তু আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারি। কমিউনিটি পুলিশ বাড়াতে পারি। নাগরিকদের একটি সমন্বিত ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসতে পারি। সবাই মিলে উদ্যোগী হলে অবশ্যই সুফল মিলবে। আমি নগরবাসীকে অনুরোধ জানাই, আপনারা টেবিল ঘড়ি মার্কায় ভোট দিন। আমরা সবাই মিলে যে ঢাকার স্বপ্ন দেখি তাকে জয়যুক্ত করুন।
প্রশ্ন : নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আগে আপনার বাবাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা কর্মকর্তার বক্তব্য নিয়ে কিছু কথাবার্তা হয়েছে। পরে দুঃখ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। সে বিষয়ে কি কিছু বলার আছে?
আনিসুল হক : আমার বাবা মো. শরীফুল হক একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুজিবনগর সরকারের অধীনে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার পুরস্কারস্বরূপ বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁকে দুই বছরের সিনিয়রিটি দিয়েছিল। আমাকে হেয় করতেই কোনো কোনো গণমাধ্যম এমন ভুল খবর প্রকাশ করে বলে আমার ধারণা।