গ্রেনেড হামলার বিচার এক যুগেও হয়নি
২০০৪ সালের ২১ আগস্টে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার বিচার এক যুগেও শেষ হয়নি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, এই হামলার মাধ্যমে সে সময়কার বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছিল।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১-এ একই সঙ্গে হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা চলছে। এ মামলা বহু হাত ঘুরে ও নানা নাটকীয়তা শেষে এখন সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। হত্যা মামলায় আসামি রয়েছেন ৫২ জন; অপরদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় আসামি রয়েছেন ৪১।
যার বিপরীতে সাক্ষী রয়েছেন মোট ৪৯১ জন। আদালত এ পর্যন্ত ২২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন। ২২৪তম আসামির সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের পূর্বনির্ধারিত জনসভা ছিল। দলীয় কার্যালয়ের সমানে ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চ গড়ে জনসভার কাজ চলছিল। জনসভার শেষ দিকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়ার সময় সেখানে মুহুর্মুহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দলের অনেক নেতাকর্মী। মঞ্চে মানববর্ম তৈরি করে দলীয় প্রধানকে হামলার হাত থেকে প্রাণে বাঁচান দলের নেতারা।
গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী মহিলা লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, আওয়ামী লীগকর্মী রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগমসহ ২৪ নেতাকর্মী মারা যান।
এ ছাড়া আহত হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, এ এফ এম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা পারভীন, নাসিমা ফেরদৌস, রুমা ইসলামসহ শতাধিক নেতাকর্মী।
এই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মতিঝিল থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর হয়ে এসএসপি (সহকারী পুলিশ কমিশনার) আব্দুর রশিদ হয়ে মুন্সি আতিকুর রহমানের কাছে যায়।
অভিযোগ আসে, মুন্সি আতিক ও আব্দুর রশিদ মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজান। তাঁর কাছ থেকে মিথ্যা জবানবন্দি আদায় করা হয়। তাঁর পরিবারকে প্রতি মাসে টাকা দেওয়ার কথাও বলা হয়। মাঝে এফবিআই ও ইন্টারপোল মামলার তদন্ত করে।
২০০৮ সালের ১১ জুনে এ মামলার প্রথম অভিযোগপত্র দেন সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর।
এতে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, মুফতি হান্নান ছিলেন ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী। তাদের লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করা। এ ছাড়া ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে সে সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ভূমিকা ছিল বলেও উল্লেখ করা হয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ৩ আগস্ট মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য দায়িত্ব পান পুলিশের বিশেষ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ।
পুনর্তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ৩ জুলাই আবদুল কাহার আকন্দ আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। সেই অভিযোগপত্রে বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে আসামি করা হয়।
এ ছাড়া গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকার করে ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আটজন আসামি।
তাঁরা হলেন হুজি নেতা মুফতি হান্নান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, আরিফ হাসান সুমন ও রফিকুল ইসলাম সবুজ।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমানের সহকারী আকরাম উদ্দিন শ্যামল সাংবাদিকদের জানান, ‘এ মামলার অভিযোগপত্রে মোট সাক্ষী সংখ্যা ৪৯১ জন। এ পর্যন্ত ২২৩ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন ও বর্তমানে ২২৪তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
মামলার পঞ্চম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি (সহকারী পুলিশ পরিদর্শক) মোহাম্মদ ফজলুল কবিরের জেরার জন্য আগামী ২২ ও ২৩ আগস্ট দিন ধার্য আছে।
আইনজীবী আরো জানান, আসামিদের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাকি ১৮ পলাতক আসামির অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ চলছে। একই সঙ্গে পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টাও অব্যাহত আছে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদিন মেজবাহ এনটিভি অনলাইনকে জানান, রাষ্ট্রপক্ষের কারণে মামলার বিচারে বিলম্ব হচ্ছে। রাষ্ট্রপক্ষ এর আগে পুনর্তদন্তের নামে দেড় বছর নষ্ট করেছে। এখন এ মামলায় ৫২ জন আসামির বিপরীতে ৪৯১ জন সাক্ষী রাখা রয়েছে। মামলায় যারা সংশ্লিষ্ট নয় তাঁদেরও সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে। এতে করে মামলায় বিচার শেষে হতে বিলম্ব হচ্ছে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আরো বলেন, এ মামলায় তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক হয়রানির জন্য আসামি রাখা হয়েছে। তাঁরা এ মামলায় কেউ জড়িত নন।
ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১-এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দীনের আদালতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার দায়ের হওয়া হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের বিচার দুটি একসঙ্গে চলছে। বিস্ফোরক মামলায় আসামি ৪১ জন ও হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে ৫২ জনকে।
আসামিদের মধ্যে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হানিফ, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন, গ্রেনেড সরবরাহকারী মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন। তাঁদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে।
অন্যদিকে এ মামলায় আটজন আসামি জামিনে রয়েছেন। এঁরা হলেন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং মামলার তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আবদুর রশীদ ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম।
এ ছাড়া কারাগারে আটক রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহিম, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বিরসহ ২৫ জন।