মীর কাসেমের নৃশংসতার সাক্ষী ‘মৃত্যুর কারখানা’ ডালিম হোটেল
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মীর কাসেম আলীর নৃশংসতার নির্মম সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেল। মুক্তিযুদ্ধকালীন আলবদর বাহিনীর এই হেডকোয়ার্টারের পরিচিতি ছিল ‘মৃত্যুর কারখানা’ হিসেবে।
একাত্তরে মীর কাসেম পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠনের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর নেতা ছিলেন। সে সময়ই তিনি ডালিম হোটেলকে মৃত্যুর কারখানায় পরিণত করেছিলেন।
মীর কাসেমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়েও বারবার উঠে এসেছে এই ডালিম হোটেলের কথা। মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গঠন করা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ছিল ১২টি নির্যাতনের এবং দুটি নির্যাতনের পর হত্যার। আর এ ১৪টি ঘটনাই ঘটেছে ডালিম হোটেলে। আর ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ে ৮৫০ বার ডালিম হোটেলের নাম উল্লেখ রয়েছে।
চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় টিঅ্যান্ডটি কার্যালয়ের পেছনে হাজারী গলির ডালিম হোটেলের নাম ছিল ‘মহামায়া ডালিম ভবন’। ১৩৭৩ বঙ্গাব্দে নির্মিত ভবনটির মালিক ছিলেন চন্দ্র মোহন নাথ। একাত্তরে ভবনের একটি অংশে সপরিবারে থাকতেন তিনি, বাকি অংশটুকু ব্যবহৃত হতো বোর্ডিং হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু পর হিন্দু অধ্যুষিত ওই এলাকার জনগণের সঙ্গে ওই পরিবারটি পালিয়ে যায়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ওই ভবনটি দখল করে আলবদররা। দখলের পর ভবনটির নতুন নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। আর এ ভবনেই মীর কাসেমের নেতৃত্বাধীন নৃশংস আলবদর বাহিনী তাদের হেডকোয়ার্টার গড়ে তোলে।
একাত্তরের এপ্রিল থেকেই মূলত ডালিম হোটেল চট্টগ্রামের আল-বদর বাহিনীর সব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। অন্তত কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষকে এই ভবনে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
একাত্তরের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্রে জানা যায়, একাত্তরে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর নেতা মীর কাসেম আলী সহযোগীদের নিয়ে খোলা জিপে চড়ে অস্ত্রসহ পুরো শহরে টহল দিতেন। আর টহলে নানা স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
উনিশশো বায়াত্তরে প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়, শহরের কোথাও কোনো মুক্তিযোদ্ধা গোপনে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর পেলেই মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে বদর বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের ডালিম হোটেলে ধরে নিয়ে আসতেন। তাদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও তাদের অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাওয়া হতো। নির্যাতনের পর বন্দিরা পানি খেতে চাইলে প্রস্রাব খেতে দেওয়া হতো।
এই ডালিম হোটেলেই মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিকামী মানুষদের শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। নির্যাতিত মানুষদের অমানুষিক চিৎকার কান্নার শব্দ শোনা যেত দূর থেকেও। আলবদর বাহিনীর হাতে আটক এই মানুষগুলোর মুক্তির প্রত্যাশায় স্বজনরা এসে আন্দরকিল্লার টেলিগ্রাফ ভবনের সামনে ভিড় জমাত। কিন্তু স্বজনদের আহাজারি, ছেলের খোঁজে মায়ের চোখের পানি আলবদরদের এতটুকুও বিচলিত করেনি। প্রতিদিনই বাড়িটি থেকে বেরুত নির্যাতনে বিকৃত লাশের সারি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মীর কাসেম আলীর নির্যাতনের মূল কেন্দ্র ছিল এই ডালিম হোটেল। আর এ হোটেলের মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের নির্যাতনের মূল চরিত্র ছিলেন আলবদর নেতা মীর কাসেম আলী। নৃশংসতার জন্য যিনি ‘বাঙালি খান’ নামে পরিচিত ছিলেন।